দুর্নীতির বরপুত্র তাকসিমের সময়ে যত দুর্নীতি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২৪, ০৪:০৭ পিএম
বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও রাজস্ব লোপাটে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের সময়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে রাজধানীবাসীর পানি ও পয়ঃসেবার দাম বেড়েছে।
এছাড়া বৈদেশিক সহায়তানির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়নে এ সংস্থাটি প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
দুর্নীতির বরপুত্র ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাপের মুখে পদত্যাগ করেছেন। ১৪ আগস্ট অনলাইনে স্থানীয় সরকার বিভাগে তিনি তার পদত্যাগপত্র জমা দেন। তার আবেদন মঞ্জুর করে গতকাল স্থানীয় সরকার বিভাগ তার নিয়োগ বাতিল করে আদেশ জারি করেছে।
এমডি পদ শূন্য হওয়ায় সংস্থার জ্যেষ্ঠ ডিএমডিকে এমডির দায়িত্ব পরিচালনার জন্য বলা হয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে প্রায় ১৫ বছর ধরে ঢাকা ওয়াসার এমডির দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী তাকসিম এ খান আইনের তোয়াক্কা করেননি। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন বলে দাপট দেখিয়েছেন দুর্নীতিবাজ তাকসিম এ খান।
দেশের প্রচলিত আইনে বিধান না থাকলেও বিদেশে বসে অফিস করেছেন। বহুবার এমন আদেশ জারি করে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতির ক্ষেত্রেও আইনের তোয়াক্কা করেননি। ঢাকা ওয়াসা বোর্ড সংস্থার পরিচালনা পর্ষদ হলেও তিনি বোর্ডকে নিজ হাতের পুতুলে পরিণত করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বজন পরিচয়ে দোর্দণ্ড প্রতাপ দেখিয়েছেন।
খেয়ালখুশি মতো কাজ করে, প্রকল্প গ্রহণ করে এবং সংস্থার কাজ বাস্তবায়নে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক গ্রুপকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে তাদের দুর্নীতির সহায়ক হিসাবে কাজে লাগিয়েছেন। তাদের ব্যবহার করে ঢাকা ওয়াসার অর্থ লোপাট করেছেন।
জানা গেছে, ঋণনির্ভর পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনাগার প্রকল্পের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে দুর্নীতি হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা, দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের নিুমানের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৬০০ কোটি টাকা, পানি ও পয়ঃবিলের ৩ হাজার ২২১ কোটি টাকা এবং ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ৬২১ কোটি টাকা।
ঢাকা ওয়াসা সংশ্লিষ্টরা জানান, দুর্নীতিবাজ এমডি প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের অপসারণ ও গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন করছে ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে প্রতিদিন অফিস সময় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কয়েকশ কর্মকর্তা-কর্মচারী কাওরান বাজারস্থ ঢাকা ওয়াসা ভবনে আন্দোলন করেছে। গতকালও তারা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে।
সংগঠনের আহ্বায়ক প্রকৌশলী মো. মোজাম্মেল হক বলেন, আমাদের চাপের মুখে প্রকৌশলী তাকসিম এ খান পদত্যাগ করেছেন। এখনো সংস্থায় তার সহযোগীরা রয়ে গেছেন, তাদের অপসারণ করতে হবে। নইলে ঢাকা ওয়াসা দুর্নীতিমুক্ত হবে না। একই সঙ্গে প্রকৌশলী তাকসিম এ খানকে গ্রেফতার এবং তার দোসরদের বরখাস্ত ও গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
ঢাকা ওয়াসা সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ঢাকা ওয়াসায় বর্তমানে কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রকৌশলী তাকসিম এ খানকে দুর্নীতিতে সহায়তা করেছেন অনেকে। তাদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন-প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম, আনোয়ার সাত্তার সবুজ, বদরুল আলম, মো. জয়নাল, মোস্তাফিজুর রহমান, ওয়াজ উদ্দিন, মো. ইয়ার খান, গাজী আশরিব, মো. জুবায়ের, শারমিন হক আমির, সেলিম মিয়া, কানিজ ফাতেমা, অপু মিয়াজি প্রমুখ।
ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যানারে আন্দোলনকারীরা তাদের সবাইকে বরখাস্ত এবং গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফা জানান, প্রকৌশলী তাকসিমের সময়ে ঢাকা ওয়াসায় বহু অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। বর্তমান সরকারকে অনুরোধ করব প্রকৌশলী তাকসিমসহ তাদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করতে। এটা করতে পারলে তা বহুল আলোচিত ঢাকা ওয়াসার দুর্নীতির বিচারের ঘটনাটি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে।
তিনি জানান, অতিষ্ঠ হয়ে ২০২৩ সালের ১৭ মে স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রকৌশলী তাকসিমের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে চিঠি লিখেছিলাম। মন্ত্রণালয় তার তদন্ত না করে উপরন্তু চার দিনের মাথায় আমাকে সরিয়ে দেয়। দুর্নীতির টাকার জোরে তিনি ধরাকে সরাজ্ঞান করেছেন। পাশাপাশি তাকে রাজনৈতিকভাবে সহায়তা করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম সহিদ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, বিগত সময়ের সব অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত করা হবে। যারা দোষী সাব্যস্ত হবেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর যারা বঞ্চিত রয়েছেন, তাদেরও মূল্যায়ন করা হবে। যার যা প্রাপ্য তাকে তা দেওয়া হবে। আর নগরবাসীর পানি ও পয়ঃসেবা সহজীকরণে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।