বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন: সরকারি হাসপাতালেই ৪০৭ জনের মৃত্যু
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২৪, ০৩:৫১ এএম
ফাইল ছবি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত হয়ে ১৫ জুলাই থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ১৮ হাজার ৫৭৬ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের দাবি, মৃত্যু ব্যক্তিদের মধ্যে ১১৭ জন হাসপাতালে ভর্তি এবং ২৯০ জনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছিল। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বাইরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বিএসএমএমইউ) কয়েকটি স্বায়ত্তশাসিত চিকিৎসাকেন্দ্র এবং সারা দেশের বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে কতজন চিকিৎসা নিয়েছেন এবং কতজন মারা গেছেন সে তথ্য দিতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
বিশেষজ্ঞরা যুগান্তরকে বলেছেন, দেশে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যভুক্ত হাসপাতাল-ক্লিনিক আছে তিন হাজারের বেশি। সবমিলে প্রায় ৫ হাজার বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দালনে আহত অনেকেই এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাছাড়া স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের সঙ্গে নিহতদের ক্ষতিপূরণ ও আহতদের চিকিৎসা-পুনর্বাসনের বিষয় জড়িত। ফলে সরকারি-বেসরকারি সবগুলোর সঠিক তথ্য জানানো জরুরি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে-আন্দোলনে আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা ব্যক্তিরা বুলেট, রাবার বুলেট, গুলি, ছররা গুলি, টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, ধারালো অস্ত্র, লাঠি ও ইট-পাটকেলের আঘাতে আহত হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই চোখ, হাত, পা, মুখ, মাথা, বুক ও পিঠে গুরুতর জখমের শিকার ছিলেন।
অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) শাখা থেকে পাওয়া তথ্যমতে ঢাকা বিভাগের হাসপাতালগুলোতে ১০ হাজার ৫৭৬ জন চিকিৎসা নিতে এসেছেন। শারীরিক পরিস্থিতি গুরুতর হওয়ায় তাদের ১ হাজার ২৪৫ জনকে ভর্তি করা হয়। ২৩৮ জন মারা যান। মৃতদের মধ্যে ৬৭ জন হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় এবং ১৭১ জনকে হাসপাতালে আনার পর চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।
ঢাকার পরে সবচেয়ে বেশি আহত ও মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রামে। এই বিভাগের সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে এসেছেন ১ হাজার ৯৩২ জন। তাদের মধ্যে ৫০৪ জনকে ভর্তি করে সেবা দেওয়া হয়। চট্টগ্রামে মারা গেছেন ৪৮ জন। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৯ জন ভর্তি অবস্থায় এবং ৩৯ জনকে হাসপাতালে আনার পর মৃত ঘোষণা করা হয়।
এছাড়া বরিশাল বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ হাজার ৪৪২ জন, হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে ৩১৫ জনকে। ভর্তি রোগীদের কেউ মারা না গেলেও দুজনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রথম মৃত্যু হয় রংপুর বিভাগে। ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যু হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে-এই বিভাগের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ১ হাজার ২১৩ জন চিকিৎসা নিতে এসেছেন। আহতদের ৭৬৫ জনকে বিভাগের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৩ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। আরও ১৩ জনকে হাসপাতালে আনার পর মৃত ঘোষণা করা হয়।
রাজশাহী বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯৯৭ জন, ভর্তি হয়েছে ৮১২ জন এবং মারা গেছেন ২৩ জন। মৃত্যুদের মধ্যে ১৪ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এবং ৯ জনকে হাসপাতালে আনার পর মৃত ঘোষণা দেওয়া হয়।
সিলেট বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯৯৫ জন, হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হয়েছে ৩০০ জনকে। সিলেটের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুজন এবং ২১ জনকে মৃত অবস্থায় চিকিৎসকের কাছে আনা হয়।
খুলনা বিভাগে আহত হয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ৯৭৫ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। তাদের মধ্যে ৪৯০ জনকে ভর্তি করা হয়। খুলনায় মারা গেছেন ৩৫ জন। তাদের মধ্যে ৯ জন হাসপাতালে এবং ২৬ জনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়।
আন্দোলনে সবচেয়ে কম আহত ও মারা গেছেন ময়মনসিংহ বিভাগে। ময়মনসিংহের হাসপাতালগুলোতে ৪৪৬ জন চিকিৎসা নিতে এলে ১২৩ জনকে ভর্তি করা হয়। যাদের মধ্যে তিনজন মারা যান এবং ৯ জনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়।
জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত-নিহতের তথ্য চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা থেকে ১২ আগস্ট সারা দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল ও সব বিভাগীয় পরিচালককে চিঠি পাঠানো হয়।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য পেতে বাংলাদেশ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদককে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। সবাইকে ৩ কর্ম দিবসের মধ্যে তথ্য দিতে বলা হয়। এ সময় বিএসএমএমইউ ও বেসরকারি হাসপাতালগুলো ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠান তথ্য দিয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. মুনিরুজ্জামান ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, তার জানা মতে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালসহ এলাকাভিত্তিক কিছু বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে আহতরা সেবা নিতে এসেছিলেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিঠির কপি পাওয়ার পর অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। তারা অধিদপ্তরের তথ্য না পাঠিয়ে থাকলে পুনরায় তাগাদা দেব।
তবে যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, আন্দোলনে আহত হয়ে রাজধানীর বনশ্রীর বেসরকারি হাসপাতালেই ১ হাজার ২০০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন এবং ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাড্ডার এএমজেড হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ হাজার ৫০০ জন মারা গেছেন ২৫ জন, সাভারের এনাম মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়েছেন ২৭০ জন মারা গেছে ৩৪ জন। মিরপুরের ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতাল, ডা. আজমল হাসপাতাল, আলোক হেলথ কেয়ার ও আল হেলাল স্পেশালাইজড হাসপাতালে ১ হাজার রোগী ভর্তি এবং ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, যাত্রাবাড়ী জেনারেল হাসপাতাল, প্রো-অ্যাক্টিভ, অনাবিল হাসপাতাল, ধানমন্ডির ইবনে সিনা, পপুলার, ল্যাবএইড হাসপাতালে অসংখ্য রোগী চিকিৎসা নিতে গিয়েছেন। যাদের অনেকেই মারা গেছেন।
জানতে চাইলে এমআইএসের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এটা প্রাথমিক তথ্য। সব প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। বেসরকারি তথ্য হাসপাতাল-ক্লিনিক শাখা দিতে পারবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার (পরিচালক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, সরকারি হাসপাতালের বাইরে হাতেগোনা দু-একটি বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য এসেছে। তথ্য না দিলে প্রয়োজনে উচ্চপর্যায়ের কমিটি করা হবে।