‘গণঅভুত্থ্যান-পরবর্তী বাংলাদেশ’ আলোচনায় বক্তারা
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা করা উচিত
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২৪, ১০:০১ পিএম
ফাইল ছবি
দেশের বিশিষ্টজনরা বলেছেন, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের প্রথম কাজ হওয়া উচিত যত দ্রুত সম্ভব সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে মামলা করা। এজন্য প্রয়োজনে জাতিসংঘের সহায়তা নেওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন তারা। বলেছেন, এটি করা না হলে কোটা সংস্কার আন্দোলনে শহিদদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। পাশাপাশি তারা রাষ্ট্র সংস্কারের নানা দিক তুলে ধরেছেন।
সোমবার সকালে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের আয়োজনে ‘গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ : এখন কী করতে হবে?’ শীর্ষক বিশেষ ওয়েবিনারে কথা বলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডিভেলপমেন্টের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মির্জা এম হাসান।
সমাপনী বক্তব্য দেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। সঞ্চালনায় ছিলেন সাংবাদিক মনির হায়দার।
প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে গত সরকারের স্বৈরাচারী ব্যবস্থার কমান্ড স্ট্রাকচারে যিনি ছিলেন, শেখ হাসিনা, তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা করা। এটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করতে হবে। ১০ বছরের কথা বাদ দিলেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইন অনুযায়ী রোম চুক্তিতে স্বাক্ষর করা দেশের অংশ হিসাবে অর্টিক্যাল সেভেনে যেসব অভিযোগের কথা বলা হয়েছে, ১৪ জুলাইয়ের পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার সেগুলোর প্রতিটি করেছে। তাই ফৌজদারি মামলা বা যাই করুক, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে অবিলম্বে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করাটা এই সরকারের জরুরি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কারণ, সেটি না করা হলে প্রতিদিন আপনি তাকে একধরনের ‘ইমপিউনিটি’ দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে এই সাবেক স্বৈরাচার একটি বিশেষ রাষ্ট্র ভারতের আনুক‚ল্য পেয়ে এবং তার পরিবারের লোকজন যেসব কথাবার্তা বলছেন, সেগুলো খোলাখুলি বর্তমান সরকারের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে। যার অর্র্থ হচ্ছে, অন্যকিছু বাদ দিলেও যে ৫০০-এর বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা। বর্তমান সরকার এটা না করলে জাতিসংঘের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। আরেকটি পন্থা হলো ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে যাওয়া।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমরা এমন একটা অবস্থায় এসে গিয়েছিলাম, যেটি অসহনীয়। এ ধারণাই মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে এ গণ-অভুত্থ্যান ঘটেছে। তাই বর্তমান সরকারকে বলব, ক্রান্তিকালীন সরকার। যারা অপরাধ করেছে, অন্যায় করেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, যারা ফৌজদারি অপরাধ করেছে, যারা আর্থিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে অপরাধ করেছে; তাদের শাস্তির আওতায় আনা হোক। তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হোক। এজন্য তদন্ত করতে হবে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যে নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশা সবার, সেখানে রাষ্ট্র সংস্কারের কেন্দ্রবিন্দুতে নিশ্চিত করা প্রয়োজন জনগণের রায়, জনগণের ক্ষমতায় জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র নিশ্চিত হয়েছে। এটি করতে হবে। সেখানে অন্যতম সংস্কারগুলোর মধ্যে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বাক্স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, তথ্য জানার অধিকার, ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, বিগত সরকার গোয়েন্দানির্ভর একটা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিল। যত কালো আইন, মিথ্যাচারনির্ভর যে অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, সেটাকে ভেঙে দেওয়াও নিশ্চিত করতে হবে।
ড. মির্জা এম হাসান বলেন, ২০০৭ সালের তত্ত¡াবধায়ক সরকার যে সংস্কার করেছিল, আইনকানুন ও নানা ক্ষেত্রে সেগুলোতে চাইলেই ফিরে যেতে পারি। সেই সময়ের তত্ত¡াবধায়ক সরকারের পরবর্তী আওয়ামী সরকার এগুলোকে ধুয়ে-মুছে শেষ করে দেয়। এবার আমাদেরকে রাষ্ট্র-সমাজের সম্পর্ক নতুন করে সাজাতে হবে। যা যা করা হবে, এর একটি সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে আসতে হবে।
প্রবন্ধে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব রাষ্ট্র সংস্কারের নানা দিক তুলে ধরেন। তার মধ্যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও ভারসাম্যকরণ, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, প্রতিষ্ঠান সংস্কার, পরিসংখ্যান জালিয়াতি থামানো, অর্থনৈতিক পুনরুত্থান, সঠিক মুদ্রানীতি, মুদ্রাস্ফীতি রোধ, ব্যাংকিং ব্যবস্থা পুনর্গঠন করা, বাজেট রিফর্ম, ডিজিটাল অর্থনীতির নিরাপত্তা, মেধাভিত্তিক নিয়োগ, চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটমুক্ত বাজার, ঘুস-হয়রানিবিহীন সেবা, ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার মতো বিষয়গুলো উঠে আসে।
ওয়েবিনারে নতুন সংবিধান প্রয়োজনের বিষয়টিও উলেখ করেন কেউ কেউ।