শেখ হাসিনা সরকারের পতন নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০২৪, ০৮:৩৩ পিএম
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগের পর ভারতে চলে যান তিনি। এখনো পর্যন্ত তিনি দিল্লিতে অবস্থান করছেন।
সরকারের পতনের পর বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত এবং পাকিস্তান যেমন রয়েছে, তেমনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইইউ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
এ ইস্যুতে তাদের প্রতিক্রিয়ায় কেউ কেউ বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে, আবার কেউ বাংলাদেশের প্রতি তাদের অঙ্গীকারের কথা পুনরুল্লেখ করে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে- এমন আশা প্রকাশ করেছে।
ভারত
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, খুব কম সময়ের নোটিশে তিনি (শেখ হাসিনা) সাময়িকভাবে ভারতে আসার অনুমতি চান। একই সঙ্গে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ‘ফ্লাইট ক্লিয়ারেন্সের’ জন্যও অনুরোধ আসে আমাদের কাছে।
মঙ্গলবার বিষয়টি নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর পার্লামেন্টে বক্তব্য দেন।
২৪ ঘণ্টার বেশি সময় পরে শেখ হাসিনার অবস্থান এবং বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করে ভারত।
তবে বিগত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছি বলে জানান ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
জয়শঙ্কর জানান, ঢাকায় হাইকমিশন ছাড়াও চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেটে উপ-দূতাবাস রয়েছে। আমরা আশা করব, ওই ভবনগুলোতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে সে দেশের সরকার।
তিনি বলেছেন, সংখ্যালঘুদের অবস্থার দিকে আমরা সবসময় নজর রাখছি। তাদের সুরক্ষা দিতে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সংগঠন নানা কর্মসূচি নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এটিকে আমরা স্বাগত জানাই। যতক্ষণ না আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দৃশ্যত পুন:স্থাপিত হচ্ছে সে পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই আমাদের উদ্বেগ থাকবে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পার্লামেন্টে দেওয়া বক্তব্যে আরও বলেন, এই জটিল পরিস্থিতিতে আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীগুলোকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সোমবার রাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভাপতিত্বে ক্যাবিনেটের নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে জরুরি বৈঠকে বসেছিল।
বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনসহ সিনিয়র কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সেনাবাহিনীর প্রশংসা করেছে যুক্তরাষ্ট্র
সোমবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেছেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করছে যুক্তরাষ্ট্র।
তিনি বলেছেন, ওয়াশিংটন বাংলাদেশের জনগণের পাশে রয়েছে এবং আরও সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে সবপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।
মিলার বলেন, আমরা চাই, বাংলাদেশের জনগণ তাদের সরকার ঠিক করবেন। এ বিষয়ে আগামী দিন ও সপ্তাহগুলোতে আমরা নজর রাখব।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার সোমবার ধৈর্য প্রদর্শনের জন্য বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রশংসা করেছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আহবান জানিয়েছে।
হোয়াইট হাউসের একজন মুখপাত্র সোমবার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আহবান জানিয়ে আসছিল এবং আমরা গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আহবান জানাই। সামরিক বাহিনী যে ধৈর্য প্রদর্শন করেছে, তা প্রশংসনীয় ব্যাপার।
হোয়াইট হাউস ও যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট পৃথক বিবৃতিতে সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে এবং দ্রুততর সময়ে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহবান জানিয়েছে।
যুক্তরাজ্য যা বলেছে
বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার যুক্তরাজ্যের ফরেন কমনওয়েলথ ও ডেভেলপমেন্ট অফিসের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বাংলাদেশে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও প্রাণহানি রোধ করতে সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান।
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে গত দুই সপ্তাহে নজিরবিহীন সহিংসতা এবং মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
সেনাবাহিনী প্রধান একটি ক্রান্তিকালের ঘোষণা করেছেন। এমন অবস্থায় সহিংসতার অবসান, শান্তি পুনরুদ্ধার, পরিস্থিতি শান্ত ও প্রাণহানি রোধে সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশের জনগণ গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনায় জাতিসংঘের নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ ও স্বাধীন তদন্তের দাবি করেছে। যুক্তরাজ্যও বাংলাদেশের একটি শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ দেখতে চায়।
প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে পারেন- এমন একটি খবর বেরিয়েছিলো তিনি ভারতে পৌঁছার পরপরই। তবে যুক্তরাজ্য বলেছে, রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার উদ্দেশ্যে কারও যুক্তরাজ্য ভ্রমণের সুযোগ নেই।
এছাড়া শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ও তার মায়ের যুক্তরাজ্যে আশ্রয় চাওয়ার সম্ভাবনার বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলেনি।
চীন
বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
মঙ্গলবার ৬ আগস্ট চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান এ কথা বলেছেন। ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যে এ বিষয়ে জানানো হয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী এবং কৌশলগত উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে চীন আন্তরিকভাবে আশা করে যে বাংলাদেশে দ্রুত সামাজিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
গত ৮ থেকে ১০ জুলাই শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চীন সফর করেন। সেখানে তাকে লালগালিচা সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। সেই সময় উভয় দেশের মধ্যে ২১টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছিলেন, উভয় দেশের সম্পর্ক-সমন্বিত কৌশলগত উন্নয়ন অংশীদারিত্বে উন্নীত হয়েছে।
আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং ইইউ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদলের পর সোমবারই বিশ্বব্যাংক বলেছে, তারা বাংলাদেশকে যেসব ঋণ দিয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করা হবে এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রতি তাদের অঙ্গীকার অব্যাহত থাকবে।
এদিকে মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ বলেছে, বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উৎখাত হওয়ার পরও সংস্থাটি বাংলাদেশ ও এর জনগণের প্রতি পুরোপুরি অঙ্গীকারবদ্ধ।
সর্বশেষ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে সংস্থাটি।
আইএমএফের বিবৃতিতে বলা হয়েছে- বাংলাদেশ এবং এর জনগণের প্রতি আমরা সম্পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ থাকব। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে।
এদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও, শেখ হাসিনার পতনের পর সারাদেশে যে ব্যাপক সহিংসতা ও হামলা ছড়িয়ে পড়েছে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইইউ।
সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ দেওয়া এক পোস্টে বাংলাদেশে ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি লিখেছেন- ইইউ মিশনের প্রধানরা বাংলাদেশে ধর্মীয়, জাতিগত এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর এবং তাদের প্রার্থনার জায়গায় একাধিক হামলার খবরে খুবই উদ্বিগ্ন।
পাকিস্তান
বুধবার বাংলাদেশ দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে আশা করে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে পাকিস্তান।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে এ মন্তব্য প্রকাশ করে দেশটি।
বিবৃতি বলা হয়, পাকিস্তানের জনগণ ও সরকার বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ ও দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন প্রত্যাশা করছে। আমরা বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশের মানুষের চেতনা ও ঐক্য তাদের একটি সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে।
সূত্র: বিবিসি।