টানা ৩২ ঘণ্টা অনশন
ডিবি কার্যালয়ে ৬ সমন্বয়ককে নির্যাতনের অভিযোগ
সিরাজুল ইসলাম
প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৪, ০২:১৩ এএম
ফাইল ছবি
অবশেষে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয় থেকে ছাড়া পেয়েছেন বৈষম্যবিরোধী অন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক। তারা হলেন-নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, আবু বাকের মজুমদার, আসিফ মাহমুদ ও নুসরাত তাবাসসুম। ছাড়া পাওয়ার পর সমন্বয়ক ও পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, ডিবি কার্যালয়ে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। নির্যাতনের মুখেই তারা ২৮ জুলাই তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।
পরে তারা টানা ৩২ ঘণ্টা অনশনে যান। অনশনরত অবস্থায় বৃহস্পতিবার দুপুরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ছেড়ে দেওয়ার আগে তাদের পরিবারের সদস্যদের ডেকে নেওয়া হয় ডিবি কার্যালয়ে। পরে ছয় পরিবারের সদস্যদের জন্য পৃথক ছয়টি গাড়ির ব্যবস্থা করে ডিবি। ওইসব গাড়িতে সমন্বয়কদের বাসাবাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
সমন্বয়কদের মধ্যে নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকেরকে শুক্রবার বিকালে ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে আনা হয়। তাদের মধ্যে নাহিদ ও আসিফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আর বাকের ছিলেন তাদের সঙ্গে। পরদিন শনিবার সন্ধ্যায় সায়েন্স ল্যাব এলাকা থেকে সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। রোববার ভোরে মিরপুরের এক আত্মীয়ের বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয় নুসরাত তাবাসসুমকে। এরপর থেকে তারা মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়েই ছিলেন। এর আগে ১৯ জুলাই মধ্যরাতে খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়ায় এক বন্ধুর বাসা থেকে নাহিদকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। একদিন পর পূর্বাচল এলাকায় তাকে ফেলে যাওয়া হয়। নাহিদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছিল আঘাতের চিহ্ন। পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অপর দুই সমন্বয়ক আসিফ ও বাকেরকেও একই দিন কে বা কারা তুলে নিয়ে যায়। ৫ দিন পর তাদের দুজনকে চোখ বাঁধা অবস্থায় যেখান থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল, সেখানে ফেলে যাওয়া হয়।
সমন্বয়কারীদের ডিবি কার্যালয়ে নেওয়ার পর ডিবির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল। নিরাপত্তা দেওয়ার জন্যই তাদের ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আন্দোলন ঘিরে নাশকতার বিষয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কিন্তু ডিবির এ বক্তব্যে সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না সমন্বয়কদের পরিবারের সদস্যসহ বিভিন্ন মহল। পরিবারের সদস্যরা জানান, তারা ডিবির কাছে নিরাপত্তা চাননি। সমন্বয়কদের কেউ কেউ অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ছিলেন। চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে ডিবি কার্যালয়ে আটকে রেখে নিরাপত্তা দেওয়ার কোনো মানে নেই বলে তারা জানান। আদালতে এক রিট আবেদনের শুনানিতে সোমবার বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এসএম মাসুদ হোসাইন দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ মন্তব্য করেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে তাদের খাওয়ানোর ছবি প্রকাশ করে জাতির সঙ্গে মশকরা করা হচ্ছে। বলা হয়, ‘ডিবি অফিসে যাকে-তাকে ধরে নিয়ে যাবেন, তারপর খাবার টেবিলে বসাবেন। এভাবে জাতির সঙ্গে মশকরা করবেন না।’ বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হয় ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকেও। বেশ কয়েকজন আইনজীবী গণমাধ্যমকে জানান, নিরাপত্তা হেফাজতের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। নানা সমালোচনার মুখে বুধবার ডিবি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদকে। বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটায় ডিবি কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচির ডাক দেন বিশিষ্ট নাগরিকরা। মানববন্ধন শুরুর আগেই ডিবি থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কদের। এরপরও ডিবি কার্যালয়ের সামনে পূর্বঘোষিত মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়।
ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার বিকালে হাসনাত আবদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, আমরা এখনো ট্রমার মধ্যে আছি। আমাদের কীভাবে আটক করা হয়েছে? আটকের পর ডিবি হেফাজতে কী অবস্থায় ছিলাম? সামনের দিনগুলোতে কীভাবে আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়া হবে-এসব বিষয়ে সমন্বিতভাবে ব্রিফ করে মিডিয়াকে জানানো হবে। এর আগে একটু স্বাভাবিক হতে দিন। তিনি বলেন, ডিবি কার্যালয়ে আমাদের একসঙ্গে রাখা হয়নি। ছয়জনকে আলাদা ছয়টি কক্ষে রাখা হয়। হারুন সাহেব যে খাওয়ার ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেন তার আগে আমাদের একসঙ্গে করা হয়। পরিবারের সদস্যরা যখন এসেছিল তখনও আমাদের একসঙ্গে করা হয়। আমরা কী অবস্থায় ডিবি কার্যালয়ের ভেতরে সংবাদ সম্মেলন করে কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিই, সেটা নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পারছেন। এসব বিষয় নিয়ে আমরা সংবাদ সম্মেলন করব। তিনি বলেন, আমরা এমন পরিস্থিতিতে ছিলাম যে, অনশনে যেতে বাধ্য হয়েছি। টানা ৩২ ঘণ্টা অনশনে থাকার পর আমাদের মুক্তি দেওয়া হয়। তিনি বলেন, প্রথমে আসিফ অনশন শুরু করেন। এটা জানার পর সবাই অনশনে যাই। তিনি বলেন, ডিবি অফিস থেকে যে গাড়ি দেওয়া হয়েছে, সেই গাড়িতে সরাসরি কুমিল্লার গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছি। শিগগিরই ঢাকায় ফিরব। ঢাকায় ফেরার পর সবাই একসঙ্গে হয়ে ব্রিফিং করে বিস্তারিত জানাব।
সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের বাবা বদরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ডিবি কার্যালয়ের নির্যাতন ও ৩২ ঘণ্টার অনশনে খুব দুর্বল অবস্থা আছে। এই মুহূর্তে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। কথা বলার মতো পরিস্থিতি হলে সে সবই জানাবে। তিনি বলেন, বাসায় ফেরার জন্য ডিবির পক্ষ থেকে সবাইকে (কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক) কালো গ্লাসের গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়। ডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আমরা যেন কারও সঙ্গে কথা না বলি। তিনি বলেন, ডিবির কাছে আমরা কোনো নিরাপত্তা চাইনি। তারপরও ডিবি নিরাপত্তার নামে আমাদের সন্তানদের তুলে এনে নির্যাতন চালিয়েছে। মানসিক নির্যাতন বেশি হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডিবি কার্যালয়ে নেওয়ার আগে আমার ছেলেকে তার এক বন্ধুর বাসা থেকে তুলে নিয়ে নির্মম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করি। চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে নিরাপত্তার নামে ডিবি কার্যালয়ে এনে আটক রাখা সত্যিই দুঃখজনক। তিনি আরও বলেন, ডিবি পুলিশ তুলে নেওয়ার পর প্রথমে বিষয়টি স্বীকারই করেনি। প্রথমদিন আমাদের দেখা করতে দেয়নি। পরদিন দেখা করতে দেয়। ডিবি কার্যালয়ের ভেতর থেকে বিবৃতি দেওয়ার আগ পর্যন্ত তারা খুবই নির্যাতনের মুখে ছিল। বিবৃতি দেওয়ার পর অনেকটা স্বাভাবিক আচরণ করেছে।
নাহিদ ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এই মুহূর্তে শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ভালো নয়। বাসায় ফিরেই স্যালাইন নিয়েছি। একটু সুস্থ হলে ছয়জন মিলে বসে সব কথা ক্লিয়ার করে বলব। তিনি বলেন, ডিবি কার্যালয় থেকে বারণ করা হয়েছে, যাতে মিডিয়ায় আমরা কোনো কথা না বলি। তারা তাদের মতো করে বলেছে। কিন্তু আমরা তাদের কথা শুনব না। আমরা আমাদের মতো করে সবই বলব। এক্ষেত্রে আমাদের একটু সময় দেন। আগে আমাদের সুস্থতা দরকার।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সারজিস আলম লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, কথা দিয়েছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের থেকে কাউকে গ্রেফতার করবেন না, মামলা দিয়ে হয়রানি করবেন না। আপনারা কথা রাখেননি। আপনারা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর আঘাত করেছেন। সারা দেশে আমার স্কুল-কলেজের ভাইবোনদের ওপর লাঠিচার্জ করেছেন। যাকে ইচ্ছা তাকে জেলে পাঠিয়েছেন। আন্দোলনকারীকে খুঁজে না পেলে বাসা থেকে ভাইকে তুলে নিয়েছেন, বাবাকে হুমকি দিয়েছেন। যারা একটিবারের জন্যও এ আন্দোলনে এসেছেন তারা শান্তিতে ঘুমাতে পারেন না, গ্রেফতারের ভয়ে থাকেন। এমন অনেকে আছেন যাদের পরিবার এখনো তাদের খোঁজ পায়নি। এমন তো হওয়া উচিত ছিল না! কোথায় মহাখালীর সেতু ভবন আর কোথায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়! অথচ আপনারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে মহাখালীর সেতু ভবনে হামলার জন্য গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিলেন।
সারজিস তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, রিকশা থেকে নামিয়ে প্রিজনভ্যানে তুলছেন, বাসা থেকে তুলে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছেন। আমার বোনদের রাস্তায় ফেলে পিটিয়েছেন। কী ভাবছেন? এভাবেই সবকিছু শেষ হয়ে যাবে? ৬ দিনের ডিবি হেফাজত দিয়ে ছয়জনকে আটকে রাখা যায়, কিন্তু এই বাংলাদেশের পুরো তরুণ প্রজন্মকে কিভাবে আটকে রাখবেন? দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার করে যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছেন প্রতিনিয়ত সেগুলো কিভাবে নিবৃত করবেন? পুলিশের উদ্দেশে তিনি বলেন, এ দেশের মানুষের ক্ষোভ পুলিশের ওপর নয়। এই ক্ষোভ আপনার গায়ের ওই পোশাকটার ওপর। যে পোশাকটাকে ইউজ করে বছরের পর বছর আপনাদের দিয়ে এ দেশের অসংখ্য মানুষকে দমন-পীড়ন করা হয়েছে, অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছে, জেল আর আদালতের প্রাঙ্গণে চক্কর কাটানো হয়েছে, সেই পোশাকটার ওপর। ওই পোশাকটা ছেড়ে আসুন আমাদের সঙ্গে, বুকে টেনে নেব।’ তিনি আরও বলেন, এ পথ যেহেতু সত্যের পথ, ন্যায়ের পথ, তাই যে কোনো কিছু মোকাবিলা করতে আমরা বিন্দুমাত্র বিচলিত নই। যতদিন না এ বাংলাদেশ আন্দোলনকারীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে; গণগ্রেফতার, জুলুম, নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে; ততদিন এ লড়াই চলবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিএমপির ক্রাইম অ্যান্ড অপস বিভাগের বদলির আদেশপ্রাপ্ত) বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, আমি আজ ডিবি থেকে বিদায় নিচ্ছি। তাই বিষয়টি নিয়ে টেলিফোনে এই মুহূর্তে কিছু বলতে চাচ্ছি না। সন্ধ্যায় তিনি সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন। এ সময় শিক্ষার্থীদের নির্যাতন ও অনশনের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো উত্তর না দিয়েই চলে যান।