প্লেসমেন্ট শেয়ারের ‘ডন’ মতিউর, মিলল ১২টি বিও অ্যাকাউন্ট
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৪, ১১:১২ পিএম
ফাইল ছবি
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বড় কর্তা হলেও ২০০৮ সাল থেকে সক্রিয়ভাবে শেয়ারবাজারে জড়িত ছিলেন ছাগলকাণ্ডে বহুল সমালোচিত মতিউর রহমান। দুইভাবে তিনি বাজার থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতেন। এগুলো হলো প্লেসমেন্ট বাণিজ্য এবং কারসাজির আগাম তথ্য জেনে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার কিনে বেশি দামে বিক্রি করতেন।
মতিউর এবং তার পরিবারের সদস্যদের ১২টি বিও অ্যাকাউন্ট থেকে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি চাকরি বিধিমালা অনুসারে এ ধরনের কাজ বেআইনি এবং অনৈতিক। তাদের মতে, একই সঙ্গে তিনি কয়েকটি অপরাধ করেছেন। প্রথমত, তিনি সরকারি বিধিমালা লঙ্ঘন করেছেন।
দ্বিতীয়ত, বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করে মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ করেছেন। তৃতীয়ত, তিনি সিকিউরিটিজ আইনের লঙ্ঘন করেছেন।
মতিউর ইস্যুতে কী ‘অগ্রগতি’ দুদকের, জানালেন সচিব
চতুর্থত, তিনি শেয়ার লেনদেন করতে গিয়ে বিভিন্ন প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। তবে ইতোমধ্যে তাকে পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে এনবিআর। সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ থেকে তাকে অপসারণ করা হয়েছে। এছাড়া শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বলছে, মতিউরের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে অর্থনীতি ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তা বড় পদে থেকে এ ধরনের প্লেসমেন্ট বাণিজ্য করতে পারেন না। এছাড়া তার এভাবে শেয়ার লেনদেনও অন্যায়। তিনি বলেন, এ ধরনের কার্যক্রম অনৈতিক এবং বাজারকে প্রভাবিত করতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সূত্র বলছে, ইতোমধ্যে আখাউড়া বন্দর দিয়ে তিনি বিদেশে পালিয়েছেন। যুগান্তরের কাছে থাকা তথ্য অনুসারে তার পাসপোর্ট নম্বর ই০০০১১৬৫২। তবে পাসপোর্ট দিয়ে বিদেশে যাওয়ার তথ্য মেলেনি। ধারণা করা হচ্ছে তিনি অন্য কোনো পাসপোর্ট ব্যবহার করেছেন।
এনবিআরের সদস্য মতিউর রহমান কাস্টসম এক্সসাইজ অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান। এনবিআরের এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ। চাকরির শুরুতে তিনি ট্রেড ক্যাডারে যোগদান করেন। এরপর নানা তদবিরে এসেছিলেন কাস্টমস ক্যাডারে। স্বল্প সময়ের জন্য পোস্টিং ম্যানেজ করেছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু অর্থের মোহে অন্ধ হয়ে যাওয়া এই কর্মকর্তার মূল পরিচয় হয়ে ওঠে শেয়ার ব্যবসায়ী হিসাবে। ২০০৮ সাল থেকে শুরু করেন শেয়ার ব্যবসা। অল্পদিনেই পুঁজিবাজারে পরিচিতি পান ‘ম্যারাডোনা’ হিসাবে। দুর্বল কোম্পানির শেয়ার কম দামে কিনে কারসাজির মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে দেন। লুটে নেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। এক সময় তার মূল ব্যবসাই হয়ে ওঠে প্লেসমেন্ট বাণিজ্য। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে তিনি নিজেও একটি ট্রেক হাউজের অনুমোদন পান।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সেকেন্ডারি মার্কেটেও দুর্বল কোম্পানির শেয়ার কারসাজিতে প্রত্যক্ষ সহায়তা করেন তিনি। যেমন কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়াতে হলে ওই কোম্পানির আয় ও সম্পদ বৃদ্ধি জরুরি। এক্ষেত্রে বেশ কিছু কোম্পানি কৃত্রিমভাবে আয় বাড়িয়ে দেখিয়েছেন।
এসব কোম্পানির মধ্যে অন্যতম হলো এমারেল্ড অয়েল, ফরচুন সুজ, সিএনএ টেক্সটাইল অন্যতম। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো ভুয়া আয় দেখাতে চাইলেও আয়ের বিপরীতে সরকারকে ভ্যাট, ট্যাক্স দিয়েছে এ ধরনের সনদ জরুরি। এনবিআরের এই সনদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কোম্পানিতে সহায়তা করেছেন মতিউর।
ব্রোকারেজ হাউজ ঘুরে দেখা গেছে, শাহজালাল ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট, ইমতিয়াজ সিকিউরিটিজ এবং আইল্যান্ড সিকিউরিটিজে তার নিজের নামে থাকা বিও অ্যাকাউন্টে অন্তত ১২টি কোম্পানির লাখ লাখ শেয়ার প্লেসমেন্ট নিয়েছেন মতিউর। একইভাবে নিজের দুই সন্তান অর্ণব ও ঈপ্সিতা, স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলী, বোন হাওয়া নুর বেগমের নামেও এসব ব্রোকারেজ হাউজে থাকা বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্লেসমেন্ট বাণিজ্য করেছেন।
টার্গেট করে দুর্বল কোম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়েও থেমে থাকেননি মতিউর। এসব কোম্পানি যাতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় তার ব্যবস্থাও করে দিতেন। তালিকাভুক্তির পর শুরু হয় কারসাজির মাধ্যমে দাম বৃদ্ধি। যা পুরোপুরি অনৈতিক।
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ (সংশোধিত ২০১১) ৫’র ধারার ৫নং উপধারায় বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারী তার এখতিয়ারে থাকা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোনো সংস্থার পুনঃপুন আতিথ্য পরিহার করবেন। আচরণ বিধির ১৫নং ধারায় বলা হয়, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী ফটকা কারবারে বিনিয়োগ করিতে পারিবেন না।
এক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত মূল্য অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করে, ওইসব সিকিউরিটিজ ক্রয়-বিক্রয়কে ফটকাবাজি বিনিয়োগ হিসাবে গণ্য হবে।
একই ধারার ২নং উপধারায় বলা হয়, বিনিয়োগের ফলে সরকারি কর্মচারী সরকারি কাজে প্রভাবিত হতে পারেন অথবা কর্তব্য পালনে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারেন, সরকারি কর্মচারী নিজে সে ধরনের বিনিয়োগ করতে অথবা পরিবারের কোনো সদস্যকে বিনিয়োগের অনুমতি দিতে পারবেন না। এছাড়া সরকারি কর্মচারী হয়ে কোনো কোম্পানির গোপন তথ্য পেয়ে থাকলেও তাতে বিনিয়োগ করতে পারবেন না। ১৫নং ধারার ৩নং উপধারায় বলা হয়, কোনো সরকারি কর্মচারী এমন কোনো কিছুতে বিনিয়োগ করতে পারবেন না, কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যার মূল্য পরিবর্তন সম্পর্কিত তথ্য একজন সরকারি কর্মচারী হিসাবে তিনি জ্ঞাত, কিন্তু সাধারণ জনগণ তা জানে না। তবে এসবের কোনো কিছুই আমলে নেননি মতিউর।
এদিকে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি বলছে, মতিউরের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, শেয়ার লেনদেনের ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন হলে সংশ্লিষ্ট আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া এ ধরনের ঘটনা তদন্তে সরকারি অন্য কোনো সংস্থা সহযোগিতা চাইলে বিএসইসি তা দিতে প্রস্তুত রয়েছে।