এমপি আনার হত্যা
জবানবন্দি না দিলেও মিন্টুর সংশ্লিষ্টতা পাচ্ছে ডিবি
ইমন রহমান
প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৪, ০৯:১২ পিএম
ফাইল ছবি
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার জেলা আওয়ামী লীগ নেতা সাইদুল করিম মিন্টু আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি।
রিমান্ডে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন তিনি। তবে নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও এমপি আনার হত্যাকাণ্ডে তার সংশ্লিষ্টতা পাচ্ছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
আনার হত্যায় গ্রেফতার দুই আসামির আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আর প্রযুক্তিগত তথ্যে হত্যা পরিকল্পনা ও অর্থ দেওয়ার ঘটনায় মিন্টু জড়িত এমন প্রমাণ রয়েছে তাদের হাতে। তবে রিমান্ড শেষ হওয়ার পাঁচ দিন আগেই তাকে কারাগারে পাঠানো নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
এদিকে এমপি আনারের লাশের ফরেনসিক প্রতিবেদন পেয়েছে ভারতের সিআইডি। এরপরই ডিএনএ নমুনা দিতে আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনকে ভারতে ডেকেছে তারা।
এ বিষয়ে এমপি আনারের ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুর রউফ যুগান্তরকে বলেন, বৃহস্পতিবার ভারতের সিআইডির এক কর্মকর্তা ডরিনকে ফোন করে ডিএনএ নমুনা দিতে এক সপ্তাহের মধ্যে ভারতে যাওয়ার কথা বলেছেন। আমরা বিষয়টি ডিবি পুলিশকে জানিয়েছি। ডিবির একটি টিমের সঙ্গে আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে ভারতে যাব।
উল্লেখ্য, এমপি আনার হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ঝিনাইদহ পৌরসভার সাবেক মেয়র মিন্টুকে রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে গ্রেফতার করে ডিএমপির ডিবি।
১৩ জুন তাকে আট দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ড শেষ হওয়ার পাঁচ দিন আগেই তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। রিমান্ডে মিন্টুর কাছে প্রশ্ন ছিল, আওয়ামী লীগ নেতা বাবু ও চরমপন্থি নেতা শিমুলের তথ্য অনুযায়ী তিনি এ হত্যার সঙ্গে জড়িত। বিষয়টি কীভাবে অস্বীকার করবেন? এছাড়া তার সঙ্গে শিমুল বা শাহীনের সম্পর্ক কী।
হত্যার আগে তাদের সঙ্গে কথোপকথনের প্রমাণও উপস্থাপন করা হয় মিন্টুর সামনে। তবে এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে সবকিছুই অস্বীকার করেছেন তিনি।
ডিবি বলছে, হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড শাহীনের সঙ্গে মিন্টুর কথোপকথনের বিষয়টি গ্রেফতার দুই আসামির জবানবন্দিতে উঠে এসেছে। মোবাইল ফোন ফরেনসিকে পাঠালে সেটি প্রমাণ হবে বলে ধারণা তদন্ত সংশ্লিষ্টদের। কেননা খুনিরা যোগাযোগের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেছে। ফোনের হোয়াটসঅ্যাপ থেকে সব তথ্য ডিলিটও করেছে মিন্টু। ওইসব তথ্য পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশে আমেরিকান দূতাবাসের সহায়তা চাওয়া হতে পারে বলে ডিবি সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে আনার হত্যায় গ্রেফতার অপর চার আসামি দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। কিন্তু মিন্টুর ক্ষেত্রে জবানবন্দি ছাড়াই রিমান্ড শেষ হওয়ার আগে কারাগারে পাঠানো নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এমপি আনারের মেয়ে ডরিন প্রথম থেকেই দাবি করে আসছেন, একটি মহল প্রকৃত খুনিদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে। মিন্টুকে রিমান্ড শেষের আগে কারাগারে পাঠানো নিয়ে আনারের ঘনিষ্ঠজনদের ধারণা, রাজনৈতিক চাপের মুখে ব্যাহত হচ্ছে তদন্ত কার্যক্রম। তারই অংশ হিসাবে মিন্টুকে রিমান্ড শেষ হওয়ার আগেই কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ফলে মিন্টুর সঙ্গে আর যারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত তারা আড়ালেই রয়ে যাবেন।
তবে ডিবির তদন্ত কর্মকর্তাদের বক্তব্য, যে বিষয়গুলো জানতে মিন্টুকে রিমান্ডে আনা হয়েছিল সে বিষয়ে মিন্টু বক্তব্য দিয়েছেন। ফলে তাকে আর রিমান্ডের প্রয়োজন পড়েনি। ওইসব বক্তব্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। প্রয়োজন পড়লে তাকে আবারও রিমান্ডে আনা হবে।
এছাড়া তাদের দাবি, সিআরপিসির ১৬৭ ধারা এবং পিআরবি রুল-৩২৪-এ বলা আছে, তদন্ত কর্মকর্তার রিমান্ডের উদ্দেশ্য সফল হলে মেয়াদ হাতে থাকা সত্ত্বেও আসামিকে অহেতুক পুলিশ হেফাজতে না রেখে আদালতে পাঠিয়ে দেওয়াই উত্তম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিবি পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, মিন্টুর হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে স্বীকার আর অস্বীকারের কিছু নেই। সাক্ষ্য-প্রমাণে হত্যা পরিকল্পনায় তার জড়িত থাকার বিষয় উঠে এসেছে। তার স্বীকার করা আর না করায় কিছু যায় আসে না। তাকেসহ গ্রেফতার অন্যদেরও ফের রিমান্ডে আনা হবে।
আমাকে এতিম করে মিন্টু বলে এতিমের সঙ্গে আছি: ডরিন
এর আগে মিন্টুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুকে ৬ জুন রাতে গ্রেফতার করে ডিবি। ৯ জুন তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ডে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিতে রাজি হন বাবু। তারপর আদালত বাবুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন। বাবুর জবানবন্দিতেই আনার হত্যার নেপথ্যে মিন্টুর নাম আসে।
এ মামলায় ২৩ মে শিমুল ভূঁইয়া ওরফে সৈয়দ আমানুল্লাহ, ফয়সাল আলী সাজী ওরফে তানভীর ভূঁইয়া ও সেলেস্তি রহমানকে গ্রেফতার দেখানো হয়। তারা তিনজনই ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। বর্তমানে তারা কারাগারে আছেন। তবে আনার হত্যার এখনো মূল রহস্য রয়েছে শাহীনকে ঘিরে। তাকে দেশে ফেরাতে সরকারের জোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মনে করছে তদন্তসংশ্লিষ্টরা। কেননা তদন্তের সব বিষয় গিয়ে থামছে শাহীনে। এছাড়া ভারতে পুলিশের কাছে গ্রেফতার সিয়াম শাহীনের ঘনিষ্ঠ লোক। সিয়ামকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দ্রুতই ভারতে যাবে ডিবি।
উল্লেখ্য, এমপি আনার ১২ মে ভারতে যান। পরদিন ১৩ মে কলকাতার নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন তিনি। ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে ২২ মে। ওইদিন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় আনারের মেয়ে ডরিন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করেন। এছাড়া ভারতে একটি হত্যা মামলা হয়। দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত হিসাবে এ পর্যন্ত ১২ জনের নাম এসেছে। তাদের মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন সাতজন।
তারা হলেন বাংলাদেশে গ্রেফতার শিমুল ভূইয়া, তানভীর, সেলেস্তি, বাবু ও মিন্টু। এছাড়া ভারতে গ্রেফতার আছে সিয়াম ও কসাই জাহিদ। আরও তিনজনের নাম এসেছে, যারা হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত নন। তবে আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে তারা ব্যবহ্যত হতে পারেন বলে ডিবির সন্দেহ। হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন। এছাড়া পলাতক আছেন মোস্তাফিজ ও ফয়সাল।
মিন্টুর মুক্তির দাবিতে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের মানববন্ধন : সাইদুল করিম মিন্টুর মুক্তির দাবিতে লাগাতার আন্দোলনের অংশ হিসাবে বৃহস্পতিবার দুপুরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ঝিনাইদহ শাখার ডাকে শহরের পোস্ট অফিস মোড়ে এ কর্মসূচি পালিত হয়। এতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক নেতাসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেয়।
জেলা জোটের সভাপতি শান্ত জোয়ারদারের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন খুলনা গ্রুপ ফেডারেশনের সদস্য নাজিম উদ্দিন জুলিয়াস, বিহঙ্গ সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক শাহিনুর আলম লিটন, সাবেক অধ্যক্ষ শুসেন্দু কুমার ভৌমিক, উপাধ্যক্ষ আব্দুস সালাম প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, মিন্টুকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এ মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। সংস্কৃতিমনা মিন্টুকে দ্রুত ঝিনাইদহে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি করেন তারা।