Logo
Logo
×

জাতীয়

জাল দলিলে জমি দখল হয়ে গেলে কী করবেন?

Icon

বিবিসি বাংলা

প্রকাশ: ০৬ মে ২০২৪, ০৪:৫৭ পিএম

জাল দলিলে জমি দখল হয়ে গেলে কী করবেন?

ভুয়া তথ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি তৈরি করে, নকল কাগজপত্রের মাধ্যমে করা হয় জমি বা ফ্ল্যাটের ভুয়া দলিল। তারপর এসব দলিল বিভিন্ন ব্যাংকে রেখে নেওয়া হয় মোটা অংকের ঋণ। এইভাবে কাজকর্ম করে, এমন বেশ কয়েকটি চক্র সক্রিয় রয়েছে বাংলাদেশে।

শুক্রবার এমনই একটি সংঘবদ্ধ চক্রের আটজনকে আটক করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডি।

আটকের পর শনিবার এক বিবৃতিতে সিআইডি জানায়, এই চক্রটি নির্বাচন কমিশনের কিছু কর্মচারীর মাধ্যমে গোপনে এনআইডি তৈরি করত। পরে তারা ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে জাল দলিল তৈরি করে জালিয়াতি করত।

দলিল জালিয়াতি করে অন্যের সম্পত্তি দখল কিংবা নানা ধরনের অপরাধের ঘটনার পর প্রশ্ন উঠছে, কীভাবে এ থেকে সুরক্ষা পাবেন নাগরিকরা? কিংবা এ নিয়ে আইনি প্রতিকারই বা কী রয়েছে?

এসব জাল-জালিয়াতির তদন্তের দায়িত্ব সিআইডির। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, মাঝে মাঝেই এরকম জাল-জালিয়াতির খবর পাই আমরা। এসব জালিয়াতির মূলে রয়েছে এনআইডি। কোনও ভাবে একটা এনআইডি করতে পারলেই, এই চক্রগুলো জালিয়াতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

তবে নির্বাচন কমিশন বলছে, কোনও কোনও চক্র কম্পিউটারের দোকান থেকে জাল এনআইডি তৈরি করছে। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার নেই।

নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, যে সব পার্টনার প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছ থেকে এনআইডি সেবা নিয়ে থাকে তাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যাচাইয়ের সময় যেন ভুয়া এনআইডি দেখে নেয়। আর ইসির কর্মচারীদের মধ্য থেকে যারা এই জালিয়াতিতে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে এনআইডি জালিয়াতি করলেই তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে এবং আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, এই জালিয়াতি বন্ধে আমরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে নামজারি করতে যাচ্ছি। সে ক্ষেত্রে কোনও ব্যক্তির কী পরিমাণ জমি রয়েছে সেই তথ্য তার এনআইডি কার্ডের সাথে যুক্ত করা হবে।

তিনি আরও বলছেন, তবে এই পদ্ধতি চালু হতে সময় লাগবে। কিন্তু এটি চালু হলে এসব জাল-জালিয়াতি বন্ধ ও এক জনের জমি আরেক জন দখল করাও বন্ধ হবে।

ভুয়া নথিপত্র বা জালিয়াতির মাধ্যমে এনআইডি যারা তৈরি করে সেই চক্রের প্রথম ও প্রধান টার্গেট থাকে জমি দখল বা জাল দলিল তৈরি।

এক্ষেত্রে জালিয়াতি চক্রের প্রথম টার্গেট হয় দামি ও পতিত জমি। যখন কোনও জমির দীর্ঘদিন ধরে খাজনা দেওয়া হয় না, কিংবা জমিতে কেউ থাকে না তখন সেই জমির মূল মালিকের একটি ভুয়া এনআইডি তৈরি করা হয়। তারপরই সেই জমি বিক্রি ও দখলের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

ঢাকার ডেমরার সহকারী ভূমি কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ধরেন আমার এক টুকরা জমি আছে, ৫-১০ বছর ঐ জমির কোনও খোঁজখবর রাখছি না বা খাজনাও দিচ্ছি না। তখন এরকম জমি খোঁজে ওই চক্রগুলো।

তিনি বলেন, এরপরই ভুয়া এনআইডির মাধ্যমে ওটার একটা দলিল তৈরি করে। কাউকে আবার পাওয়ার অব অ্যাটর্নী দিয়েও জমি বিক্রি করা হয়। এভাবেই জালিয়াত চক্রগুলো জমি দখল ও বেচাকেনা করে।

সাধারণ জমি নামজারি বা দলিল তৈরি হয়ে থাকে সারা দেশের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলোর মাধ্যমে। সেখান থেকেই বেশির ভাগ জালিয়াতির ঘটনাগুলো ঘটে থাকে।

আইনজীবীরা বলছেন, অনেক সময় স্বাক্ষর জালিয়াতি ধরে দলিলদাতা বা গ্রহীতার সাজা হয়। এক্ষেত্রে স্বাক্ষর বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে স্বাক্ষরের সত্যতা যাচাই করিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এছাড়া ভূমি অফিস থেকে বিভিন্ন সিল পরীক্ষা করেও জালিয়াতি নির্ণয় করা যায়।

খেয়াল রাখতে হবে, অনেক আগের দলিলে আগের চিহ্নিত কিছু সিল ব্যবহারই থাকে। আগের দলিল কিন্তু সিল যদি নতুন হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে, দলিলটি জাল হতে পারে।

একই সঙ্গে তারিখটিও ভালোভাবে যাচাই করতে হবে। এছাড়া অনেক সময় অর্পিত সম্পত্তি বা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি জীবিত দেখিয়ে জাল করা হয়।

জমি জমা সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলায় দীর্ঘদিন ধরে আইনি লড়াই করছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুশান্ত কুমার বসু।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ইদানীং অনেক বড় বড় জালিয়াত চক্র গড়ে উঠেছে। তারা রেজিস্ট্রি অফিসের ভলিউম বইয়ের পাতা খুলে নিয়ে নতুন পাতা জুড়ে দেয়। বড় বড় দখল বাণিজ্য করে। এক্ষেত্রে মূল দায়ী রেজিস্ট্রি অফিস।

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যখন কেউ এ ধরনের ভুয়া আইডি ও কাগজপত্রের মাধ্যমে জালিয়াতি করতে আসে তখন চাইলেই রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মকর্তারা সেগুলো ধরতে পারেন। কিন্তু এক্ষেত্রে অনেক অসাধু কর্মকর্তা টাকা পয়সার বিনিময়ে এসব অনিয়মে জড়ান।

এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে সাতক্ষীরার একজন সাব রেজিস্ট্রার বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমরা যখন দলিলের জন্য কাগজপত্র যাচাই বাছাই করি তখন খুব অল্প সময় পাই। এছাড়া এনআইডি সঠিক কিংবা ভুয়া সেটির জন্য সার্ভারের অ্যাকসেস আমাদের কাছে না থাকায় আমরা জালিয়াতি ধরতে পারি না।

এনআইডি সার্ভারের অ্যাকসেস না থাকার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল ভূমিমন্ত্রীর কাছে।

জবাবে ভূমিমন্ত্রী বিবিসি বাংলাকে বলেন, যদি সাব রেজিস্ট্রার কর্মকর্তারা এনআইডি যাচাই করতে না পারে তাহলে অবশ্যই এ বিষয়ে একটা পদক্ষেপ নিতে হবে। এটাকে প্রতিরোধ করতে গেলে সাব রেজিস্ট্রারদের সেই সুযোগটা করে দিতে হবে। আমরা সেই উদ্যোগ নেব।

জাল দলিলে জমি দখল হলে কী করবেন?

ভূমি খাতের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, একটি জমি একাধিক মালিকের নামে করা থাকলে ধরে নিতে হবে দলিলটি জাল হতে পারে।

এক্ষেত্রে সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে মূল মালিক কে, তা নির্ণয় করতে হবে।

সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস থেকে জমির মিউটেশন বা নামজারি সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে। নামজারিতে ধারাবাহিকতা ঠিক আছে কি না, সেটা সুচারুভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

যদি দেখা যায়, সিএস জরিপের সঙ্গে বিক্রেতার খতিয়ানের কোনও গরমিল আছে, তাহলে বুঝতে হবে কোনও জটিলতা আছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, জরিপ খতিয়ানে জমির পরিমাণ পরবর্তী সময়ে যতবার বিক্রি হয়েছে, তার সঙ্গে জমির পরিমাণ মিল আছে কি না, তা যাচাই করে দেখা। দাগ নম্বর, ঠিকানা এসব ঠিক আছে কি না, এসব যাচাই করতে হবে।

সম্প্রতি কোনও আমমোক্তারনামা দলিল থাকলে তাতে উভয় পক্ষের ছবি ব্যবহার হয়েছে কি না যাচাই করতে হবে।

কোনও দান করা জমি হলে দলিলে সম্পাদনের তারিখ দেখে কবে জমিতে গ্রহীতা দখলে গেছে তা যাচাই করতে হবে। দলিলটি রেজিস্ট্রি করা কি না এবং দলিলদাতার সঙ্গে গ্রহীতার সম্পর্ক কী, তা যাচাই করতে হবে।

সহকারী ভূমি কমিশনার আসাদুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, সরকার বারবার বলছে আপনারা কর দেন, জমির সাথে থাকেন। আমার জমি আমি খোঁজ না রাখলে এমন কিছু হয়।

এক্ষেত্রে জমি যাদের আছে তাদের নিজ জমির বিষয়ে সবার আগে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।

জমিজমা কেনাবেচার ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে বিশেষ নজর দিতে বলছে পুলিশ।

সিআইডি কর্মকর্তা আবদুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমাদের সাধারণ জনগণের উচিত হবে যে কোনও জিনিস ক্রয়ের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য জায়গা বাছাই করা। কাগজপত্র ফেইক কিনা সেটা যাচাই করা। অরিজিনাল কাগজ না হলে এসব বিষয়ে এড়িয়ে চলতে হবে।

তবে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়িয়ে এ ধরনের জালিয়াতি বন্ধ করা সম্ভব বলে মনে করেন ভূমিমন্ত্রী নায়ারণ চন্দ্র চন্দ।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, আমি আসার পর থেকেই বলে আসছি সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতিমাসে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের সাথে মিটিং করে। তখন চেয়ারম্যানদেরকে যদি বলে দেওয়া হয়, চেয়ারম্যানরা যদি তাদের মেম্বারদের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ায় তাহলে এসব জালিয়াতি বন্ধ করা সম্ভব।

একের পর এক জালিয়াতির ঘটনার পর সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এ নিয়ে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই। কিন্তু জালিয়াতি চক্রও পাল্টা কৌশলী হয়ে ওঠে এসব ক্ষেত্রে।

সরকারের এসিল্যান্ড ও সাব রেজিস্ট্রার কর্মকর্তারা জানান, জরিপ করার সময় অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কোনও 'করণিক ভুল' যখন হয় তখন সেটা সহজে সংশোধন করা যায়। কিন্তু কোনও জালিয়াতির ঘটনা ঘটে গেলে সাব রেজিস্ট্রার বা ভূমি কমিশনারের কিছু করার থাকে না।

ভূমি কমিশনার আসাদুজ্জামান বলেন, যখন জমি ট্রান্সফার হয় তখন দেখা যায় যে কিছু আর করার থাকে না। যতক্ষণ পর্যন্ত একটা প্রপার কোর্ট এই দলিলকে জাল ঘোষণা না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আইনগতভাবে বলা যাবে না এই দলিলটা জাল। এটা ঘোষণার এখতিয়ার শুধুমাত্র কোর্টের।

তাই এই জালিয়াতি রোধে সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নাম জারির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ভূমিমন্ত্রী বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে প্রত্যেকের জমির তথ্য যুক্ত থাকবে তার এনআইডিতে। এনআইডি কার্ডে আমরা ওটা নিয়ে যেতে চাই। এবং সেটা যখন সাব রেজিস্ট্রার রেজিস্ট্রি করবেন তখন তিনি ওটা কম্পিউটারে ইনপুট দিয়ে খতিয়ান, ম্যাপ এবং কার নামে রয়েছে সেটা তিনি দেখতে পাবেন।

তিনি জানান, এই পদ্ধতি চালু হলে জমির দলিল জাল করার আর কোনও সুযোগ থাকবে না। সেই সাথে কেউ ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে কেউ অন্য কোনও সুযোগও নিতে পারবে না।

তবে এই পদ্ধতিতে যেতে আরও বেশ কিছুটা সময় লাগবে বলেও জানান ভূমিমন্ত্রী।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম