মানবসেবার আড়ালে যেসব ভয়ংকর অপকর্ম চালিয়েছে মিল্টন সমাদ্দার
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০১ মে ২০২৪, ০২:০০ পিএম
মানবতার ফেরিওয়ালার মুখোশের আড়ালে ভয়ংকর সব প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পরিচিত মুখ মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে। এমনকি অসহায় মানুষের নামে সংগ্রহ করা অর্থ আত্মসাৎ এবং তাদের কিডনিসহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চুরির মতো গা শিউরে ওঠা অভিযোগের মুখোমুখি মিল্টন সমাদ্দার।
এছাড়া জাল ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি এবং জমি দখলের মতো গুরুতর সব অভিযোগ এখন চাউর হচ্ছে। অসহায়-দুস্থ মানুষের সেবার কথা বলে গড়ে তোলা ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ নামের একটি বৃদ্ধাশ্রম ঘিরে তার অপকর্মের ফিরিস্তি এখন নেটদুনিয়ায় ভাইরাল।
এদিকে মিল্টন সমাদ্দার বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেকে ভালো মানুষ হিসাবে আখ্যা দেওয়ার অপচেষ্টা করলেও সবকিছুতেই রহস্যের জট ঘনীভূত হচ্ছে। এমতাবস্থায় মিল্টনের ভয়ংকর সব অপকর্মের অভিযোগের বিষয় আমলে নিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। জনস্বার্থে এ বিষয়ে কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত অভিযোগও গ্রহণ করেছে। ২৮ এপ্রিল মানবাধিকার কমিশন থেকে মিল্টনের অভিযোগের বিষয়টি নিবিড়ভাবে তদন্ত করে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও দ্রুত কমিশনে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারকে বলা হয়েছে।
মানবতার ফেরিওয়ালা মিল্টন সমদ্দারের বিরুদ্ধে নির্যাতন থেকে শুরু করে এর চেয়েও গুরুতর অভিযোগ নতুন নয়। তার আশ্রমে যেসব ভবঘুরে, পরিত্যক্ত, অসহায় মানুষ থাকতেন, তারা মারা গেলো না কই হারিয়ে গেল সেসব জানানো হয় না জিম্মাদার বা অভিভাবককে।
যেমন একটি রশিদ দিয়ে চাইল্ড এন্ড অল্ড এজ কেয়ারে রাখা হয়েছিল অজানা মহিলা নামে এক বৃদ্ধাকে। কিন্তু পরে তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। দেড় মাস পরে তার জিম্মাদার খোঁজ আনতে গেলে তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে বের করে দেয়া হয়।
এই আশ্রমে যারা মারা গিয়েছেন তাদের অনেকের শরীরেই কাটা-ছেড়ার দাগ থাকায় পাশের বায়তুস সালাহ মসজিদ মুর্দার গোসল করাতেও অস্বীকৃতি জানায়। মিল্টনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে মৃত্যুর সনদ জালিয়াতিরও। রাজধানীর দক্ষিণ পাইকপাড়ার ওয়ার্ড কাউন্সিলর জানান, ডেথ সার্টিফিকেট নেয়া হতো না কাউন্সিলর অফিস থেকে।
১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দেওয়ান আব্দুল মান্নান বলেন, যে পরিমাণ তার এখানে মৃত্যুবরণ করে তার তো একটা ডেথ সার্টিফিকেট নিতে হয়। আমি শুনেছি যে, সে নিজে নিজেই সীল মেরে দিয়ে দিতো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা সমাজসেবা অধিদপ্তর ও পুলিশ কমিশনারকে বিষয়টি তদন্ত করতে বলেছি। এ সংক্রান্ত আমাদের চিঠি চলে গেছে। আইনগতভাবে তারা তদন্ত করতে বাধ্য।’
মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকেও তদন্তের সুযোগ ছিল। কিন্তু তা না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যদি অভিযোগগুলো সত্য হয়ে থাকে, তাহলে খুবই খারাপ লোক। তারা মানুষের কিডনি বিক্রি থেকে শুরু করে নানা আজেবাজে কাজ করছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এগুলো দেখে। এখানে আনুকূল্য দেখানোর কোনো কারণ থাকে না। কারণ, এটার রেগুলেটরি বডি (নিয়ন্ত্রক সংস্থা) কিন্তু তারা না। রেগুলেটরি বডি হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এজন্য আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও তদন্তের জন্য বলেছি।’
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে ভয়ংকর সব অভিযোগ ওঠার পর থেকেই ছায়াতদন্ত শুরু করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ইতোমধ্যে মিল্টনের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগের তথ্য সংগ্রহ করেছে ডিবি মিরপুর বিভাগ।
সূত্র বলছে, ডিএমপির ঊর্ধ্বতন মহল থেকে নির্দেশনা পেলেই পুরোদমে তদন্ত শুরু করবে ডিবি।
মানবাধিকার কমিশনের চিঠির বিষয়ে জানতে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, মানবাধিকার কমিশন থেকে যদি কোনো তদন্তের নির্দেশনা আসে বা কেউ পুলিশের কাছে অভিযোগ দেয়, তাহলে সেটা খতিয়ে দেখা হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার বিভিন্ন বিষয় উঠে আসছে। অপরাধ তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা কাউকে অপরাধী বলতে পারি না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবু সালেহ্ মোস্তফা কামাল মানবাধিকার কমিশনের চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে যুগান্তরকে বলেন, আমরা এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছি। ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ নামের বৃদ্ধাশ্রমটি দেশের যে কোনো স্থানে যদি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন করে থাকে, তাহলে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব। আর যদি রেজিস্ট্রেশন না করে সে বিষয়টিও আমরা মানবাধিকার কমিশনকে অবহিত করব। তখন দেশের প্রচলিত আইনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নেবে।
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ নামের বৃদ্ধাশ্রম গড়ে রাস্তা থেকে অসুস্থ কিংবা ভবঘুরেদের কুড়িয়ে সেখানে আশ্রয় দেন। সেসব নারী, পুরুষ ও শিশুদের অসহায়ত্ব তুলে ধরে ভিডিও তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন এবং বিত্তবানদের কাছে সাহায্য চান। তার আবেদনে সাড়াও মেলে প্রচুর।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ১৬টির বেশি নম্বর এবং তিনটি ব্যাংক হিসাবে প্রতিমাসে প্রায় কোটি টাকা জমা হয়। এর বাইরে অনেকেই তার প্রতিষ্ঠানে সরাসরি অনুদান দিয়ে আসেন। অথচ এই আশ্রম ঘিরেই ভয়াবহ প্রতারণার জাল বুনেছেন মিল্টন।
তার ফেসবুক পেজ ঘেঁটে দেখা যায়, আশ্রমে সব সময় আড়াইশ থেকে তিনশ অসুস্থ রোগী থাকেন বলে ফেসবুকে প্রচার করেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় যারা মারা যান, তাদের দাফন করেন মিল্টন। আবার তার আশ্রমে অবস্থানকালেও অনেকে মারা যান। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ৯০০ মরদেহ দাফন করেছেন বলে মিল্টন দাবি করেন।
মিল্টন ফেসবুকে জানান, যাদের দাফন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ৬০০ জন তার আশ্রমে মারা গেছেন। আর বাকি ৩০০ মরদেহ রাস্তা থেকে এনে তিনি দাফন করেছেন। এসব মরদেহ রাজধানীর মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থান ও আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে বলে দাবি তার। তবে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মিল্টন সমাদ্দারের প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে সেখানে সব মিলিয়ে ৫০টি মরদেহ দাফন করা হয়েছে।
আরও অভিযোগ রয়েছে, এসব মরদেহের ডেথ সার্টিফিকেটও জাল। এছাড়া ঢাকার দক্ষিণ পাইকপাড়ায় মিল্টন সমাদ্দারের বৃদ্ধাশ্রমের কাছেই বায়তুল সালাম জামে মসজিদ। বৃদ্ধাশ্রমে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের একসময় এ মসজিদেই বিনামূল্যে গোসল করানো হতো। তার মানবিক কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে মসজিদ কর্তৃপক্ষ তাকে এ সুবিধা দিয়েছিল। তবে গোসল করানোর সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা প্রায় প্রতিটি মরদেহের বিভিন্ন স্থানে কাটাছেঁড়ার দাগ শনাক্ত করেন। এ বিষয়ে মিল্টন সমাদ্দারকে প্রশ্ন করে মসজিদ কর্তৃপক্ষ। এরপর তিনি ওই মসজিদে মরদেহ পাঠানো বন্ধ করে দেন।
মিল্টনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের মধ্যে রয়েছে আশ্রমে যেসব ভবঘুরে, পরিত্যক্ত, অসহায় মানুষ থাকতেন, তাদের বিষয়ে জিম্মাদার বা অভিভাবকদের পরবর্তী সময়ে আর কোনো তথ্য দিতেন না। এমনকি জিম্মাদার খোঁজ নিতে গেলে তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়। মিল্টনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে ডেথ সার্টিফিকেট জালিয়াতিরও। যে চিকিৎসকের সিল ও স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়, এ বিষয়ে ওই চিকিৎসক কিছুই জানেন না।
মিল্টনের বাড়ি বরিশালের উজিরপুরে। সেখানেও জালিয়াতি করে চার্চের ওপর প্রভাব খাটানোর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আশ্রমের আরেকটি শাখা খোলা হয়েছে সাভারে। সেখানেও রয়েছে জমি দখলের অভিযোগ। এদিকে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে মিল্টন সমাদ্দারকে মঙ্গলবার একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।