মনিরের মেরুল বাড্ডার ১৩ নম্বর রোডের ৪১ নম্বর বাড়িতে অভিযান চালায় র্যাব ফাইল ছবি
মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরকে অস্ত্র মামলায় খালাস দিয়েছেন আদালত। আদালতের ভাষ্য, গোল্ডেন মনিরের মামলা সাজানো, তার অস্ত্র বৈধ।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) করা একটি অস্ত্র মামলায় ঢাকার মহানগর দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান সম্প্রতি এ রায় দিয়েছেন।
আদালতের রায়ের তথ্য অনুযায়ী, র্যাব মামলায় বলেছিল, ২০২০ সালের ২২ নভেম্বর মনির হোসেনের বাড্ডার বাসায় র্যাব অভিযান চালিয়েছিল সকাল ৬টায়। বাসার তৃতীয় তলায় শয়নকক্ষের তোশকের নিচ থেকে ম্যাগাজিনভর্তি একটি পিস্তল উদ্ধার করে তারা। উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের লাইসেন্স ছিল না। অস্ত্র আইনে মামলার পর মনিরকে আদালতের অনুমতি নিয়ে সাত দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। পরে তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। অভিযোগ গঠনের পর রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ১৬ জন সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা হয়।
আদালত বলেছেন, রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া ১৬ সাক্ষীর মধ্যে দুজন পাবলিক সাক্ষী। অন্যরা সবাই পুলিশ সদস্য। মামলার ১৩ নম্বর পাবলিক সাক্ষী এমাদ উদ্দিন আদালতকে বলেন, ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে ওষুধের দোকানে কর্মরত থাকা অবস্থায় র্যাব সদস্যরা তাকে ডেকে নিয়ে যান। পরে মনিরের বাসার একটি কক্ষে সারা রাত বসিয়ে রাখা হয় তাকে। মধ্যরাতে (রাত ৩টা) র্যাব কর্মকর্তারা একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেন। পরদিন সকাল সাড়ে ১০টায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। মামলার ১৪তম সাক্ষী মোবারক হোসেন আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, তাকেও রাত সাড়ে ১০টার দিকে র্যাবের সদস্যরা ডেকে মনিরের বাসায় নিয়ে যান। তার কাছ থেকেও সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেন র্যাবের সদস্যরা।
রায়ে বলা হয়েছে- পাবলিক সাক্ষী এমাদ ও মোবারকদের উপস্থিতিতে মনিরের বাসার শয়নকক্ষ থেকে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারের অভিযোগ সমর্থন করে না। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের তথ্য বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয়, মনিরের বাসায় সকাল সাড়ে ৬টায় নয়; অভিযান চালানো হয় রাত সাড়ে ১০টায়। বিশেষ উদ্দেশ্যে মনিরের বাসায় অভিযান চালানো হয়। রাষ্ট্রপক্ষের মামলাটি সাজানো। অন্য সাক্ষীরা মনিরের শয়নকক্ষ থেকে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়।
রায়ে বলা হয়েছে, মনিরের বাসা থেকে উদ্ধার অস্ত্রের ফরেনসিক পরীক্ষা করানো হয়েছে বলে কোনো তথ্য নথিতে উল্লেখ নেই। আবার মামলা করতে দেরি হয় ১৯ ঘণ্টা ১৫ মিনিট। এত বিলম্বের ব্যাখ্যা সন্তোষজনক নয়।
রায়ের তথ্য বলছে, মামলার সাক্ষী উপপরিদর্শক (এসআই) মানিক চন্দ্র রায় আদালতকে বলেন, মনির হোসেনকে তার বাসার দোতলা থেকে গ্রেফতার করা হয়। আরেক সাক্ষী এসআই জামাল হোসেন ও এএসআই নাজিম উদ্দিন বলেন, মনির হোসেনকে গ্রেফতার করা হয় বাসার তৃতীয় তলা থেকে। অর্থাৎ সাক্ষীদের সাক্ষ্য পরস্পরবিরোধী।
আদালত আরও উল্লেখ করেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের পরিদর্শক আবদুল মালেক আদালতকে বলেছেন, তদন্তের সময় তিনি জানতে পারেন, মনির ও তার স্ত্রীর নামে দুটি লাইসেন্স করা অস্ত্র ছিল। অর্থাৎ আবদুল মালেকের সাক্ষ্য থেকে স্পষ্ট যে মনির ও তার স্ত্রীর নামে দুটি বৈধ অস্ত্র ছিল। বৈধ অস্ত্র থাকা অবস্থায় আরেকটি অবৈধ অস্ত্র ঘরে রাখার ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
দোকানকর্মী থেকে স্বর্ণ চোরাচালানি
মানি লন্ডারিং মামলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, গোল্ডেন মনির ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ১২৯টি ব্যাংক হিসাবে ৭৯১ কোটি ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৫২৩ টাকা জমা করা হয়। মনির এ আয়ের একটি অংশ সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্যদের যোগসাজশে যৌথ ও একক নামে ব্যবসায় বিনিয়োগ করে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে রূপান্তর করেছেন।
মনিরকে গ্রেফতার করার পর র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নব্বইয়ের দশকে গাউছিয়া মার্কেটে কাপড়ের দোকানের বিক্রয়কর্মী ছিলেন মনির। পরে মৌচাক মার্কেটের ক্রোকারিজের দোকানে চাকরি নেন। এরপর তিনি বিমানবন্দরকেন্দ্রিক লাগেজ পার্টি ও সোনা চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন। পরিচিতি পান ‘গোল্ডেন মনির’ নামে। বিক্রয়কর্মী থেকে লাগেজ পার্টিতে যোগ দেওয়ার পর মনির শুরুতে কর ফাঁকি দিয়ে কাপড়, প্রসাধনী, ইলেকট্রনিক পণ্য, কম্পিউটার-সামগ্রীসহ বিভিন্ন মালামাল আনা-নেওয়া করতেন। একপর্যায়ে আকাশপথে সোনা চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন।
এদিকে সিআইডির তথ্য বলছে, অপরাধলব্ধ আয় দিয়ে গোল্ডেন মনির স্ত্রী, ছেলে ও নিজের নামে সরকারি ২০টিসহ ৩০টি প্লট, ১৫টি বাড়ি, একটি আবাসন প্রতিষ্ঠান ও দুটি গাড়ির শোরুম করেছেন। অথচ মনির ২০০৯ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে দাখিল করা সম্পদের হিসাব বিবরণীতে উল্লেখ করেছিলেন, তার স্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৩ কোটি টাকা। আর অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৬৭ লাখ টাকা।