যুগান্তরের পঁচিশ, তৃতীয় যুগে পা, আপসহীন সত্যে অবিচল আস্থা
সাইফুল আলম
প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:২০ পিএম
দৈনিক যুগান্তরের যাত্রা শুরু একুশ শতকের সূচনালগ্নে। দেশের স্বপ্নদর্শী শিল্পোদ্যোক্তা যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম একটি নতুন সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেন তাঁর দূরদর্শী চিন্তাচেতনা থেকে। দেশে তখন অনেক পত্রিকা, সেই পত্রিকার ভিড়ে আরও একটি নতুন দৈনিক প্রকাশের চিন্তা ছিল রীতিমতো সাহসিকতার বিষয়। তাঁর জীবন ছিল সাহস আর সংগ্রামের সংমিশ্রণে এক স্বপ্নদর্শী পুরুষের জীবন।
২
বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে তারুণ্যে তিনি শরিক হয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। ১৯৭১-এর ৭ই মার্চের ভাষণে জাতির পিতার যে ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তির ডাক-‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
এ দুটি অবিস্মরণীয় দিকনির্দেশনা বাস্তবায়নই যেন তাঁর জীবনের সার্থকতা। অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায়-বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম সেই অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আজ যখন বিদেশে দেশের অর্থ স্থানান্তর, ঋণখেলাপি সংস্কৃতি দেশের অনিরাময়যোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে; তখনও তিনি ছিলেন এ দুই ব্যাধির ঊর্ধ্বে এক অনন্য ব্যতিক্রম। বিদেশে তাঁর একটি টাকাও রাখেননি। তিনি ঋণখেলাপিও নন-এটাই ছিল তাঁর দেশের প্রতি আপসহীন আনুগত্য। চেতনা তিনি পেয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে।
তিনি অনুভব করেছিলেন অনেক পত্রিকার ভিড়ে প্রকৃত পাঠকের পত্রিকার অভাব-তথা সাধারণ মানুষের মুখপত্রের অভাব। যে পত্রিকার পাতায় দেশের অতিসাধারণ মানুষের অন্তরের কথাগুলো স্থান করে নেবে, সত্যকে তুলে ধরবে-এমন একটি পত্রিকার অভাব। এ বোধটি ছিল দেশের আপামর জনতারও; তিনি সেটি উপলব্ধি করেছিলেন আর এ শূন্যতা পূরণে নিজের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এসেছিলেন সাহসের অটুট সংকল্পে। আর এভাবেই জন্ম ‘সত্যের সন্ধানে নির্ভীক’ দৈনিক যুগান্তরের। যুগান্তর পাঠকের অন্তরের অনুভবের পত্রিকা। মানুষের অন্তর্যাত্রার মুখপত্র। একটি নতুন শতাব্দীর প্রারম্ভে যার যাত্রা শুরু, আজ পঁচিশ বছরের পরিণত এক সত্তা।
এখনো পাঠকপ্রিয়তায় এগিয়ে থাকা যুগান্তর দেশে ও বিদেশে সর্বাধিক জনপ্রিয় জাতীয় বাংলা দৈনিক। দেশে এবং বিশ্বের ১৫৪টি দেশে ছড়িয়ে থাকা কমবেশি ৬০ লাখ বাঙালি পাঠক প্রতিদিন যুগান্তর পাঠ করেন-মুদ্রিত আকারে এবং হুবহু মুদ্রিত আকারের ই-পেপারে। এটা সম্ভব হয়েছে প্রয়াত চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের সুযোগ্য উত্তরসূরি বর্তমান চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম ও পরিচালকদের সাহসের স্বপ্নে, সাহসের পথ অনুসরণে অটল থেকেছেন বলে।
৩.
পঁচিশ বছরে যুগান্তরের অর্জন-পাঠকের আস্থা এবং বিশ্বাস। জন্মলগ্ন থেকে যুগান্তর সত্যের পক্ষে, অন্যায়-দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং দেশের স্বার্থের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আমাদের এই অবস্থানের কারণে শুরু থেকেই আমরা বিপক্ষের শত্রুতা অর্জন করেছি। কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জন্য অনেক রক্তচক্ষু দেখতে হয়েছে আমাদের। অনেক মিথ্যা মামলা মোকাবিলায় দৌড়াতে হয়েছে দেশের বিভিন্ন আদালতে।
বলাই বাহুল্য, সেসব মিথ্যা মামলাকে পরাস্ত করে জয়ী হয়েছে যুগান্তর। আমরা যেমন হুমকি-ধমকিতে নত হইনি, তেমনই অনুরোধ অনুনয়ে সত্য প্রকাশে পিছপা হইনি-আর ঠিক এ কারণেই যুগান্তর দেশের পাঠকপছন্দ এবং পাঠকপ্রিয় শীর্ষ দৈনিক।
সত্যকে সত্য বলার চ্যালেঞ্জে আমরা আপসহীন ছিলাম, আছি এবং থাকব। অগণিত পাঠকের কাছে, দেশের কাছে এটাই আমাদের অঙ্গীকার।
৪.
যেখানেই অনিয়ম, দুর্নীতি, অন্যায়-সেখানেই প্রতিবাদী মানুষের মুখপত্র যুগান্তর। যুগান্তর এই গাঁটছড়াবদ্ধ সংগঠিত কায়েমি শক্তির বিরুদ্ধে সব সময় আপামর জনতার প্রতিবাদকে তুলে ধরেছে। উপর থেকে নিচে দেশের যেখানেই মানুষের মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, সেখানেই সেসবের সবিস্তার সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে যুগান্তরে। প্রতিকার পেয়েছেন মজলুম মানুষ। পাশাপাশি পেয়েছেন এই সাহসÑতার বঞ্চনায় পাশে আছে দেশবাসী, পাশে আছে যুগান্তর।
দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি-সব অঙ্গনের মানুষ যুগান্তরকে ভরসা করেন। যুগান্তরে প্রকাশিত সংবাদ, তথ্য-উপাত্ত, বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী দিকনির্দেশনা পান তাঁরা। এটা আমার কথা নয়, তাঁদের মুখে এবং তাঁদের লেখায়ই তাঁরা জানিয়েছেন বিভিন্ন সময়। আমাদের বিভিন্ন বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে এসে তাঁরা বলেছেন, বলেছেন সামাজিক বিভিন্ন সমাবেশে। তাঁদের এ মূল্যায়ন আমাদের জুগিয়েছে সাহস ও শক্তি-সত্যের পক্ষে থাকার অটুট মনোবল।
৫.
একটি সংবাদপত্রের পঁচিশ বছরের অভিযাত্রা-বলা চলে এক বন্ধুর পদযাত্রা! এটা যে কি পরিমাণ বন্ধুর-প্রতিবন্ধকতার, তা সংশ্লিষ্টরা ছাড়া উপলব্ধি করা কঠিন। সেটা যেমন আর্থিক, সামাজিক, তেমনই অধুনা প্রাযুক্তিক। পঁচিশ বছর আগে যখন যুগান্তরের পথচলা শুরু, তখন তার পরিসর ছিল শুধু দেশের সীমানা। কিন্তু আজ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি সেই পরিসরের সীমানাকে বৈশ্বিক করে তুলেছে। আবার তার ঠিক পাশাপাশি ব্যক্তিকেও যুগান্তর তার অন্তর্জালে যুক্ত করে নিয়েছে।
পঁচিশ বছর আগে যে যাত্রার নাম ছিল ‘দৈনিক’ আজ সেই যাত্রার নাম করা যেতে পারে মুহূর্তিক। অর্থাৎ, এখন আমাদের কাজ করতে হয় প্রতিটি মুহূর্তের খবর নিয়েও। আমরা সেই চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করছি। পাঠকের প্রতিমুহূর্তের সংবাদ এবং তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করছে যুগান্তর অনলাইন।
৬.
একটি স্বচ্ছ জবাবদিহিপূর্ণ মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনে সংবাদপত্রের ভ‚মিকা সর্বজনস্বীকৃত। যে কারণে একে ‘রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ’ বলে অভিহিত করা হয়। যুগান্তর জন্মলগ্ন থেকে সংবাদপত্র হিসাবে সেই দায়িত্বশীলতার প্রমাণ রেখেছে। মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের ন্যায্য, ন্যায়ানুগ সম্পর্ক গড়ে তোলা সংবাদপত্রের স্বতঃসিদ্ধ দায়িত্ব।
এ দায়িত্ব পারস্পরিক-যেমন সংবাদপত্রের, তেমন রাষ্ট্রের। এটা হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের টিকে থাকার সত্য। এখানে পরস্পর বৈরিতার অর্থ আÍহনন। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের এমন বৈরিতার কোনো অবকাশ নেই।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি’র উপসংহারে এ সত্যকে মানুষের উপমা দিয়ে খুব সুন্দর করে ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেনÑ
‘মানুষের মধ্যে দুটো দিক আছে, একদিকে সে স্বতন্ত্র আর-একদিকে সে সকলের সঙ্গে যুক্ত। এর একটাকে বাদ দিলে যেটা বাকি থাকে সেটা অবাস্তব।’
[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রাশিয়ার চিঠি : উপসংহার]
যা ‘অবাস্তব’, তা ‘অসত্য’ আর এই অসত্যের অপনোদনই কাম্য। বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণে গিয়ে সংবেদনশীল বাঙালি কবি ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে যে ত্রুটি উপলব্ধি করেছিলেন, সেই ত্রুটি যদি বলি আজ তাঁর বাংলাদেশে লক্ষ্যযোগ্য তবে নিশ্চয়ই ভুল বলা হবে না। আমরা সেই ত্রুটি শনাক্ত করে দূর করার কাজেই ব্রত। দেশ ও দেশের মানুষের যথার্থ অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ বলে আমরা মনে করি।
‘স্বাধীনতা, সাম্য, মৈত্রী’-এসব শব্দকে শুধু স্লোগান কিংবা বুলিরূপে নয়-কাজের মধ্য দিয়ে বাস্তবে রূপায়িত করতে হবে। ‘রাশিয়ার চিঠি’তেই কবি আরও সুন্দর এবং শাশ্বত সত্যকে শাশ্বত আস্থায় লিখেছিলেন-
‘মানুষ সুখী হয় সেখানেই যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সত্য হয়ে ওঠে।’
[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রাশিয়ার চিঠি : পরিশিষ্ট]
যুগান্তরে আমরা মানুষের সঙ্গে মানুষের, সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের-‘সত্য হয়ে ওঠা’ সম্পর্ককেই বিনির্মাণ করতে চেয়েছি নিরন্তর। তাই যুগান্তরের সম্পর্ক পাঠকের সঙ্গে, দেশের মানুষের সঙ্গে, দেশের সঙ্গে ওতপ্রোত, অচ্ছেদ্য।
দ্বিতীয় যুগ পূর্ণ করে আজ যুগান্তর পা রাখছে তৃতীয় যুগে। যুগ যুগ জিইয়ে থাকুক যুগান্তরের এই অগ্রযাত্রা। এগিয়ে চলুক বাংলাদেশ, এগিয়ে চলুক যুগান্তর।
সাইফুল আলম : সম্পাদক, যুগান্তর; সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা
saifulalam.editorjugantor@gmail.com