দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নয়া মন্ত্রিসভা গঠনের মধ্য দিয়ে শুরুতেই চমক দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। গত সরকারের অনেক প্রভাবশালী মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর জায়গা হয়নি নতুন মন্ত্রিসভায়। এবার তিনি একই ধারাবাহিকতায় চমক দিতে পারেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠনের ক্ষেত্রেও। বাদ পড়া মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের দেখা যেতে পারে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে।
তাদের বাইরে অপেক্ষাকৃত নবীন, তরুণ এবং নতুন মুখদেরও দেখা যেতে পারে। প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, এমনকি স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যদের কাউকে কাউকে এবার সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদে দেখা যেতে পারে। ইতোমধ্যে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ এবং হুইপদের চ‚ড়ান্ত করেছে শাসক দল আওয়ামী লীগ। এবার সংসদীয় কমিটি গঠনের পালা। মন্ত্রিসভা গঠনের পর অনেকেরই চোখ এখন সংসদীয় কমিটিগুলোয়।
একাদশ জাতীয় সংসদে তিনটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদ জাতীয় পার্টিকে দেওয়া হয়। এর বাইরে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদকে দেওয়া হয় একটি করে সভাপতির পদ। এবারও এই তিন দলের পাশাপাশি স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যদের দেখা যেতে পারে সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদে।
বিএনপি-জামায়াতসহ তাদের বলয়ভুক্ত দল ও জোটের বর্জনের মধ্যে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে জয়ী হয়ে টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করে। জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ১১টি আসন নিয়ে টানা তৃতীয়বার জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসে। এছাড়াও ৬২টি আসনে জয়ী হন স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যরা। এবারের এ নির্বাচনে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ এবং বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি একটি করে আসন পায়।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ছায়া সরকার হিসাবে পরিচিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির দায়িত্বে কারা আসছেন, তা নিয়েও চলছে আলোচনা। জানা যায়, সদ্য বিদায়ি একাদশ জাতীয় সংসদে মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালনকারীদের প্রাধান্য দেওয়া হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠনের বেলায়। সরকারের কাজের গতি বাড়াতে এসব মন্ত্রী যেসব মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তাদের ওই মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি করার সম্ভাবনা বেশি।
মন্ত্রিসভার বাইরে থাকা শরিক দলের সদস্যরাও একাধিক সভাপতি পদ পেতে পারেন। বিরোধী দল জাতীয় পার্টি থেকেও বেশ কয়েকজন সদস্য সভাপতি থাকতে পারেন। সংসদের প্রথম অধিবেশনেই বেশির ভাগ সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন করা হবে বলে জানা গেছে।
আজ বিকাল ৩টায় ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুর সভাপতিত্বে অধিবেশনের কার্যক্রম শুরু হবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নতুন সরকার ৩৯টি মন্ত্রণালয়ের বিপরীতে ৩৭ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠন করে শাসক দল আওয়ামী লীগ। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের কাছে রেখেছেন তিন মন্ত্রণালয়। বাকি ২৫টিতে মন্ত্রী এবং ১১টিতে প্রতিমন্ত্রী দেওয়া হয়েছে। তাদের নেতৃত্বে মূলত চলবে মন্ত্রণালয়। তবে রেওয়াজ অনুযায়ী মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের কাজের তদারকি করবে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এককথায় এই কমিটিগুলোকে ছায়া সরকার বলে বিবেচনা করা হয়।
জাতীয় সংসদে সংসদীয় কমিটি আছে ৫০টি। এর মধ্যে ৩৯টি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। বাকিগুলোর মধ্যে রয়েছে কার্য-উপদেষ্টা কমিটি, কার্যপ্রণালি বিধি সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, পিটিশন কমিটি, লাইব্রেরি কমিটি, সংসদ কমিটি, বেসরকারি সদস্যদের বিল এবং বেসরকারি সদস্যদের সিদ্ধান্ত প্রস্তাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটি, সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত কমিটি এবং সরকারি প্রতিশ্র“তি সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
মূলত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে কারা আসছেন, এ নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে। অতীত পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ কমিটিগুলো করেন সংসদনেতা নিজেই। চিফ হুইপ বা স্পিকার সংসদনেতার অনুমোদনক্রমে এগুলো সংসদে উপস্থাপন করেন। পরে তা গ্রহণ করে সংসদ। স্বভাবতই সাবেক মন্ত্রী বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ সংসদ-সদস্যদের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি করা হয়।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠনের বিষয়ে বাংলাদেশের সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদের দফা (১)-এ বলা হয়েছে, সংসদ-সদস্যদের নিয়ে সংসদ (ক) সরকারি হিসাব কমিটি, (খ) বিশেষ অধিকার কমিটি এবং (গ) সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে নির্দিষ্ট অন্যান্য স্থায়ী কমিটি গঠন করবে। দফা (২)-এ সংসদীয় কমিটির ক্ষমতা ও কার্যাবলির বর্ণনা রয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, কমিটি সংবিধান ও অন্য কোনো আইন সাপেক্ষে (ক) খসড়া বিল ও অন্যান্য আইনগত প্রস্তাব পরীক্ষা করতে পারবে; (খ) আইনের বলবৎকরণ পর্যালোচনা এবং অনুরূপ বলবৎকরণের জন্য ব্যবস্থাদি গ্রহণের প্রস্তাব করতে পারবে; (গ) জনগুরুত্বসম্পন্ন বলে সংসদ কোনো বিষয় সম্পর্কে কমিটিকে অবহিত করলে সে বিষয়ে কোনো মন্ত্রণালয়ের কাজ বা প্রশাসন বিষয়ে অনুসন্ধান বা তদন্ত করতে পারবে। কোনো মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি সংগ্রহ এবং প্রশ্নাদির মৌখিক বা লিখিত উত্তর লাভের ব্যবস্থা করতে পারবে। এবং (ঘ) সংসদ কর্তৃক অর্পিত অন্য যে কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারবে। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে সব কমিটির কাজের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আসতে পারেন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হতে পারেন সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আসতে পারেন সাবেক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হতে পারেন সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হতে পারেন আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে দেখা যেতে পারে জাহিদ আহসান রাসেলকে।
এছাড়াও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হতে পারেন সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হতে পারেন সাবেক মন্ত্রী ইমরান আহমেদ। রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে সাবেক মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন, খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, ভ‚মি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আসতে পারেন সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী।