আমনের বাম্পার ফলন, মজুতও পর্যাপ্ত: তবুও কেন বাড়ছে চালের দাম?
ইয়াসিন রহমান
প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২৪, ১০:৪৩ এএম
আমনের বাম্পার ফলন, মজুতও পর্যাপ্ত: তবুও কেন বাড়ছে চালের দাম?
এবার আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকারি গুদামেও চালের মজুত পর্যাপ্ত। বাজারেও পণ্যটির কোনো ঘাটতি নেই। তারপরও ভরা মৌসুমে মিল মালিকদের কারসাজিতে অস্থির চালের বাজার। দুই সপ্তাহ ধরে মিল পর্যায় থেকে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ৩০০ টাকা দাম বাড়িয়ে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে রাজধানীসহ সারা দেশের পাইকারি বাজারে হু হু করে বেড়েছে দাম। প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। পরিস্থিতি এমন-গরিবের মোটা চাল কিনতে কেজিপ্রতি ৫৬ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। সরু চাল বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৮৫ টাকায়। ফলে মূল্য নিয়ন্ত্রণে খোদ খাদ্যমন্ত্রী কঠোর নির্দেশ দিলেও বাজারে এক প্রকার দায়সারা তদারকি করছে কর্তৃপক্ষ। এতে চাল নিয়ে মিলারদের চালবাজিতে ধরাশায়ী হচ্ছেন ভোক্তা।
এদিকে সংসদ নির্বাচনের পর হঠাৎ করে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজার তদারকি শুরু করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। তবে শুক্রবার রাজধানীর বাজার ঘুরে ট্রেড লাইসেন্স না থাকা, বেশি দামে চাল বিক্রি ও মূল্যতালিকা না থাকাসহ সুনির্দিষ্ট নানা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলেও দৃশ্যমান কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি মাত্র ৩০ মিনিটেই বাজার তদারকি শেষ করে চলে যান তারা। বেলা ১১টা ১০ মিনিটে রাজধানীর মহাখালী কাঁচাবাজারে তদারকিতে আসে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব কুল প্রদীপ চাকমার নেতৃত্বে একটি টিম। সেখানে ১১টা ৩৯ মিনিট পর্যন্ত অবস্থান করেন তারা। এছাড়া বৃহস্পতিবার নওগাঁয় অবৈধভাবে ধান-চাল মজুত রাখার অপরাধে ৬ জন ব্যবসায়ীকে ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। মহাদেবপুর উপজেলার তিনটি চালকলের মালিক এবং বদলগাছী ও মান্দা উপজেলার তিন চাল ব্যবসায়ীকে এ জরিমানা করা হয়। এ নিয়ে ৩ দিনে নওগাঁয় ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
তবে হঠাৎ করে অস্থির হয়ে ওঠা চালের বাজার আগামী ৪ দিনের মধ্যে আগের অবস্থায় ফিরবে বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। বুধবার চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে করণীয় ঠিক করতে মিল মালিক, আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনার পর মন্ত্রী সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। তিনি জানান, আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। তাই কঠোরভাবে তদারকি মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হবে। সে মোতাবেক নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি করপোরেট ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও বৈঠক করা হবে।
এছাড়া চালের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার ঘটনায় বড় মিল মালিক ও করপোরেট কোম্পানিকে দায়ী করে আমদানির সুযোগ চেয়েছেন রাজধানীর পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তাদের বক্তব্য শুনে নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বৃহস্পতিবার বলেছেন, সরকার বড় কোম্পানিগুলোতে সুবিধা দিয়েছিল কম দামে চাল প্রাপ্তির আশায়। কিন্তু এর সুফল মেলেনি। তারা যদি ‘সত্যিকারের ব্যবসায়িক আচরণ’ না করলে চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যমতে (১৭ জানুয়ারি)- দেশে মোট ১৬ লাখ ৫৮ হাজার ৬২৪ টন খাদ্যশস্য মজুত আছে। এর মধ্যে চাল ১৪ লাখ ৩৫ হাজার ৩৪৮ টন, গম ২ লাখ ২২ হাজার ৪৪ টন ও ধান ১৬ হাজার ৯০০ টন। মন্ত্রণালয় বলছে দেশে খাদ্যশস্যের মজুত পর্যাপ্ত রয়েছে।
শুক্রবার নওগাঁ, কুষ্টিয়া ও দিনাজপুর মিল পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি বস্তা মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ২৪০০ টাকা। যা দুই সপ্তাহ আগে ২১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি প্রতি বস্তা মাঝারি আকারের বিআর-২৮ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ২৪০০ টাকা। যা আগে ২২০০ টাকা ছিল। আর প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৩০০০ টাকা। যা আগে ২৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
রাজধানীর কাওরান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক ও পাইকারি চাল ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই মিল পর্যায়ে সব ধরনের চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। যে কারণে বেশি দাম দিয়ে এনে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তিনি জানান, বাড়তি দামে কিনতে হওয়ায় পাইকারি বাজারে প্রতি বস্তা মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চাল ২৩৫০-২৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা দুই সপ্তাহ আগে ২২০০ টাকা ছিল। পাশাপাশি বিআর-২৮ জাতের চালের বস্তা বিক্রি হচ্ছে ২৫৫০ টাকা, যা আগে ২২০০-২৩০০ টাকা ছিল। আর মিনিকেট চালের বস্তা ৩১০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। যা আগে ২৯০০-৩০০০ টাকা ছিল।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতি কুষ্টিয়ার সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন যুগান্তরকে বলেন, ডিসেম্বর থেকে ধানের দাম প্রতিনিয়তই বাড়ছে। সব ধরনের ধানের দাম মনপ্রতি ১৮০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এ কারণে চালের দাম কেজি প্রতি ২ থেকে আড়াই টাকা বেড়েছে মোকামে।
রাজধানীর খুচরা বাজারের বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণাজাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৫৬ টাকা। যা দুই সপ্তাহ আগে ৫০-৫২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি দাম বেড়ে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকা, যা আগে ৬৫-৭০ টাকা ছিল। আর কেজিতে ৪ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি নাজিরশাল বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮৫ টাকা।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, মিলাররা সব সময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। ধান কাটার মৌসুম এলেই তারা চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ান। এবারও সেটাই হয়েছে। এবার আমন ধানের চাল বাজারে এসেছে, তারপরও দাম কমছে না। তাই মূল্য কারসাজিতে জড়িতদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে। মূল্য নিয়ন্ত্রণে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে বাজারে চাল কিনতে ক্রেতার ভোগান্তি বাড়বে।
বাজার তদারকি প্রসঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব কুল প্রদীপ চাকমা বলেন, আমরা দেখেছি কয়েকটি দোকানে নামভেদে চালের দাম কেজিতে ৫ থেকে ৬ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে। আবার যারা বস্তা কিনছেন তাদের থেকেও ৩ থেকে ৪ টাকা বেশি রাখা হচ্ছে। সবমিলিয়ে চালের বাজারে আমরা একটা অসামঞ্জস্যতা পেয়েছি। আমাদের আজকের মনিটরিং ছিল শুধু সচেতন করার জন্য। এরপরও যদি তারা ঠিক না হয়, তাহলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে প্রচলিত আইনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, ধানের জেলা দিনাজপুরে প্রশাসন ও খাদ্য বিভাগের একদিনের মজুতবিরোধী অভিযানেই বাজারে ধানের দাম কমেছে বস্তাপ্রতি (৭৫ কেজি) ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। সেই সঙ্গে বাজারে অস্বাভাবিক বেড়েছে ধানের সরবরাহ। মিল মালিকরা বলছেন, কৃষকদের কাছে ধান কিনে বিপুল মজুত গড়ে তুলেছেন একশ্রেনীর মজুতদার। এ কারনেই ধানের বাজার জিম্মি মজুতদারদের কাছে। খাদ্য বিভাগ বলছে, মজুতদারদের সিন্ডিকেট ভাঙতে অব্যাহত থাকবে এ অভিযান। এতে একপর্যায়ে চালের বাজার সহনশীল পর্যায়ে আসবে বলে আশা করছেন খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, সিন্ডিকেটের কব্জায় দেশের অন্যতম প্রধান চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগর। ধানের দাম বৃদ্ধির কথা বলে গত দুই সপ্তাহে এ মোকামে প্রতি কেজিতে চালের দাম বেড়েছে ৪-৫ টাকা। যার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। তবে ধানের মূল্য বৃদ্ধির দাবি উড়িয়ে দিয়ে জেলা বাজার মনিটরিং কর্মকর্তা সুজাত হোসেন বলেন, বাজার পর্যায়ে প্রতি মন সরু ধান ১৩৫০ টাকার বেশি বিক্রি হচ্ছে না। প্রায় ১ মাস জাতীয় সংসদ নির্বাচনের উৎসবে মেতে ছিলেন মানুষ। সেই সুযোগে খাজানগর মোকামের চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
কালাই জয়পুরহাট প্রতিনিধি জানান, সীমান্তঘেঁষা জেলা জয়পুরহাট। এ জেলায় বিভিন্ন জাতের ধান উৎপাদন হয়। আমন মৌসুমের শুরুতে ধানের সঙ্গে চালের দাম স্বাভাবিক থাকলেও গত এক সপ্তাহে ধরে ধানের দাম না বাড়লেও অস্থির চালের বাজার। প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে চালের দাম। গত দুই সপ্তাহের চেয়ে চলতি সপ্তাহে সব জাতের চালের পাইকারি বাজারে কেজিতে বেড়েছে ৫-৬ টাকা। তবে খুচরাতে বেড়েছে কমপক্ষে ১০ টাকা।