অসুস্থ গণতন্ত্রের দেশে একপক্ষীয় নির্বাচন: নিউইয়র্ক টাইমস
নিউইয়র্ক টাইমস
প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০৫:০৬ পিএম
৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দেশে গণতন্ত্র থাকবে কি না, তা-ই বড় প্রশ্ন।
প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিকে চূর্ণবিচূর্ণ করা হয়েছে। তাদের গতিশীল হওয়ার সক্ষমতা নেই বললেই চলে। এ দলটির যেসব নেতা জেলের বাইরে আছেন তারা আদালতে অফুরন্ত হাজিরায় জর্জরিত অথবা যারা পালিয়ে আছেন তাদের পিছু নিয়েছে পুলিশ।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ একপক্ষীয় প্রতিযোগিতার পথ পরিষ্কার করেছে। দলটি নির্বাচনে নিজেদেরই ডামি প্রার্থী দাড় করিয়েছে, যাতে বাহ্যিকভাবে মনে হচ্ছে নির্বাচন চ্যালেঞ্জবিহীন হয়নি।
অন্যদিকে অনেক আগে থেকেই প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছে বিএনপি। দলটির দাবি, নির্বাচনকালীন সময়ে একটি নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা হোক। কিন্তু তাদের সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন শেখ হাসিনা। ফলে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে।
বাংলাদেশে আয়োজিত এ প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন ইঙ্গিত দেয় যে, ১৭ কোটি মানুষের এই দেশটি কয়েক দশক ধরে প্রধান দুটি দলের মধ্যে পুরনো বিবাদের মধ্যে জিম্মি হয়ে পড়েছে।
তারা বার বার দেশজুড়ে ধর্মঘট, অবরোধ ও গণঅসহযোগ আহ্বান করেছে। জবাবে তাদের ওপর কড়া দমনপীড়ন চালানো হয়েছে। দলীয় নেতা ও আইনজীবিদের মতে, ২৮শে অক্টোবর মহাসমাবেশের পর বিএনপির কমপক্ষে ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কারাগারগুলো উপচে পড়ছে। তার ভিতরকার ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে রিপোর্ট পাওয়ার কথা বলেছেন ঢাকায় অবস্থানরত কূটনীতিকরা। মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন ও স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২৮শে অক্টোবর থেকে জেলে নিহত হয়েছেন বিরোধী দলের কমপক্ষে ৯ জন নেতা বা কর্মী। বিএনপি আরও একটি হরতাল আহ্বান করেছে দেশজুড়ে। এবার নির্বাচনের প্রাক্কালে এ হরতাল। এর প্রেক্ষিতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। নির্বাচন উপলক্ষ্যে রাজধানী ঢাকা ও অন্য অঞ্চলগুলোতে মোতায়েন করা হয়েছে সেনা সদস্যদের।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক পিয়েরে প্রকাশ বলেছেন, নির্বাচনের পর উভয়পক্ষের মধ্যে সহিংসতা বৃদ্ধির ঝুঁকি আছে। তিনি আরও বলেন, বিএনপি যদি ২০২৪ সালের নির্বাচনে তাদের অহিংস কৌশল ব্যর্থ বলে মনে করে, তাহলে অতীতের প্রকাশ্য সহিংসতার দিকে ফিরে যাওয়ার জন্য চাপের মুখে পড়তে পারে। পিয়েরে প্রকাশ বলেন, যদি বিএনপি ব্যাপক সহিংসতা শুরু করে তাহলে তারা একটি ফাঁদে পা দেবে। প্রধানমন্ত্রীর দল আরও বিস্তৃত দমনপীড়নের পথে হাঁটছে, তারা বিরোধীদেরকে ‘সন্ত্রাসী’ এবং ‘খুনি’ বলে বর্ণনা করে।
বাংলাদেশ সরকারের সমালোচকরা বলছেন, ৭৬ বছর বয়সি শেখ হাসিনা দেশটিকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করছেন। নিরাপত্তা বিষয়ক এজেন্সি থেকে শুরু করে আদালত, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিনি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। তাদেরকে ওইসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন যারা তার পথে আসেন না।
সর্বশেষ উদাহরণ হলো শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ৬ মাসের জেল দেওয়া হয়েছে। একে ড. ইউনূস রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। জামিনে মুক্ত আছেন তিনি। মামলার রায়ে তিনি হতাশা প্রকাশ করেছেন। তবে সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, এ মামলা রাজনৈতিক নয় এবং এটা শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলা।
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ক্রমহ্রাসমান। এ সময়ে শেখ হাসিনা সরকারের দমনপীড়নের মাত্রাও বেড়েছে।
করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এ সংকটে জ্বালানি ও খাদ্যের মূল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পশ্চিমা কূটনীতিকরা মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নেপথ্যে লুকিয়ে আছে ‘ক্লেপ্টোক্রেটিক’ চর্চা। তারা বলছেন, দেশের অভিজাত শ্রেণি ব্যাংকগুলোকে কুক্ষিগত করেছেন।
২০১৪ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার দল পার্লামেন্টের কমপক্ষে অর্ধেক আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়। এবার তা এড়াতে আওয়ামী লীগ ছোট ছোট দলগুলোকে সঙ্গে নিয়েছে। তারা এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, দলটি একটি নতুন ‘টোকেন’ বিরোধী দল সাজিয়েছে। তাদের অনেকে নির্বাচনী পোস্টারে এটা পরিষ্কার করেছেন তাদের অবস্থান কি: ‘আওয়ামী লীগ সমর্থিত’।
বিএনপির নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া গৃহবন্দি। তার ছেলে ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে নির্বাসনে। দলটির বেশির ভাগ নেতা জেলে। এ অবস্থায় রোববারের ভোটকে সামনে রেখে দলটির দৃশ্যমানতা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলন করে যাচ্ছেন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
বিএনপির হাতেগোণা যে কয়েকজন নেতাকে জেলে নেওয়া হয়নি, তিনি তাদের অন্যতম। রিজভীর নিজের বিরুদ্ধে ১৮০টি মামলা আছে আদালতে। এক সময় তিনি দলীয় কার্যালয়ে নিজেকে আবদ্ধ রেখেছেন। ঘুমিয়েছেন এক কোণায় ছোট্ট একটি বিছানায়। সেখান থেকে বেরিয়ে এলেই তিনি গ্রেফতারের ঝুঁকিতে। ১৯৮০'র দশকে সাবেক সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভকালে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন। এ কারণে একটি বেতের লাঠির ওপর ভর দিয়ে তাকে হাঁটতে হয়।
বৃহস্পতিবার ভার্চ্যুয়াল এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এই নির্বাচন বর্জন করেছি আমরা এবং সমমনা দলগুলো। এ সময় তিনি শনিবার নতুন করে হরতালের ঘোষণা দেন। তিনি আরও বলেন, এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এবং জনগণ এরই মধ্যে বুঝে গেছে যে, এই নির্বাচন হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের নৈরাজ্যের একটি মহড়া। এটা একপক্ষীয় নির্বাচন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলের অনুপস্থিতি দুঃখজনক। তিনি আরও বলেন, বিএনপি নির্বাচনে থাকলে নির্বাচন আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতো।