নির্বাচন ঘিরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে রূপগঞ্জের আতঙ্ক ‘মোশাবাহিনী’
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:০৬ পিএম
আন্ডারওয়ার্ল্ড কিলার মোশারফ হোসেন মোশা। যার নাম শুনলে ‘বাঘে-মহিষে এক ঘাটে পানি খায়’। খুন, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক কারবারসহ নানা অপকর্মের হোতা এই মোশার নামে ৪২টি মামলা রয়েছে। মূর্তিমান আতঙ্ক মোশার ভয়ে এখন তটস্থ নাওড়া গ্রামসহ কায়েতপাড়া ইউনিয়ন ও রূপগঞ্জবাসী।
চলতি বছরের শুরুর দিকে বিপুল অস্ত্রসহ র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয় মোশা। জামিনে বেরিয়ে এসে কয়েক মাস গা-ঢাকা দিয়ে থাকে। অভিযোগ উঠেছে, রূপগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়ার প্রশ্রয়ে মোশা এখন আবারো দাবড়ে বেড়াচ্ছে এলাকা। ইতোমধ্যে মোশা বিশাল অস্ত্রধারী বাহিনী গড়ে তুলেছে। ওই চেয়ারম্যানের নির্দেশে রূপগঞ্জকে অস্থিতিশীল করে তুলতে নানা ছক কষছে।
চাউর রয়েছে, কিলার মোশার ভয়ে আতঙ্কিত আওয়ামী লীগের লোকজনও। তাদের ঘায়েল করতে মোশা নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। নির্বাচনের আগে মোশাকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কায়েতপাড়া ইউনিয়নের নাওড়া গ্রামের মৃত মোতালেব ভূঁইয়ার ছেলে মোশারফ হোসেন মোশা। ছোটবেলায় সে ছিল ছিঁচকে চোর। এরপর নিজের আপন বড় ভাইকে হত্যার মাধ্যমে সন্ত্রাসী জগতে পা রাখে। গড়ে তোলে মোশাবাহিনী। তারপর থেকেই জমি দখল, ডাকাতি, অস্ত্র ব্যবসা আর লুটপাট হয়ে উঠে তার প্রধান পেশা।
তথ্যমতে, নাওড়া গ্রামের হিন্দু মুসলিম মিলে অর্ধশত নারী তার হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তার ভয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে শতাধিক পরিবার। রূপগঞ্জ ও রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তার নামে রয়েছে ৪২টি মামলা। এভাবেই সে দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে নাম লেখায়। বর্তমানেও চারটি মামলায় পরোয়ানাভুক্ত আসামি মোশা।
স্থানীয়রা জানান, তার সীমাহীন অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আট মাস আগে নাওড়া এলাকাবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়ে মোশাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় ৬ পুলিশ সদস্যসহ গ্রামের ৩৫ জন গুলিবিদ্ধ ও বহু বাড়িঘর লুটপাট হলে দেশজুড়ে চাঞ্চল্য তৈরি হয়। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী সীমান্ত এলাকা থেকে আটক হয় মোশা। তারপর সে কয়েক মাস জেল খেটে জামিনে এসেই আত্মগোপনে চলে যায়।
রূপগঞ্জবাসী জানিয়েছেন, সম্প্রতি দেশে নির্বাচনের আমেজ শুরু হলে রূপগঞ্জ থেকে এমপি পদে লড়তে আগ্রহী উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়া। তিনি তার পেশিশক্তি বাড়াতে এবং মানুষের মাঝে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করতে মোশাকে এলাকায় ফিরিয়ে আনেন। মোশা এখন আবারো নতুন করে বাহিনী গড়ে তুলেছে। অস্ত্রধারী গানম্যান নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ কারণে ভয় আর উৎকন্ঠায় রাতযাপন করছেন নাওড়া গ্রামের মানুষ। ইতোমধ্যে ৭০ জনের অস্ত্রধারী বাহিনী গড়ে তুলেছে মোশা। এজন্য অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র মজুদ করেছে।
মোশারফের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র দাবি করেছে, শাহজাহান ভূঁইয়ার পক্ষ নিয়ে পেশিশক্তি দেখানোর জন্য গত এক সপ্তাহ আগে শুটারগান, রিভলবার ও দেশি পিস্তল নিজের অস্ত্রভাণ্ডারে মজুদ করেছে। এক সপ্তাহ আগে অস্ত্রের চালানটি এসেছে। গোটা রূপগঞ্জে আতঙ্ক তৈরি করতে এসব অস্ত্র কেনা হয়েছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, এক সময়ের পুরস্কার ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর মধ্যে একজনের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে মোশা। ওই সন্ত্রাসী তাকে অস্ত্র সরবরাহ করছে বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।
সূত্রটি জানায়, আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে কায়েতপাড়ার নাওড়া এলাকায় অতর্কিত হামলার ঘটনা ঘটানোর সম্ভাবনা রয়েছে। নাওড়া এলাকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানোর পরিকল্পনা করেছে। গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণ করে আতঙ্কিত করার ছক কষেছে মোশা ও তার বাহিনী। পর্যায়ক্রমে চনপাড়া, মুড়াপাড়া, তারাবসহ বিভিন্ন এলাকায় হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছে। নির্বাচন ঘিরে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে উঠেপড়ে লেগেছে।
মোশার সঙ্গে উঠবস করেন এমন একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মোশার সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের বেশ কয়েকজন নেতার সুসম্পর্ক রয়েছে। জামায়াতের এক নেতা গত ১৫ দিন আগে ব্রিফকেস ভর্তি টাকা দিয়েছেন। তবে কেন দিয়েছেন সেটা জানা যায়নি।
সূত্রে জানা গেছে, মোশা মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত। মাদকের বড় বড় চালান মোশা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দেয়। টেকনাফ থেকে সরাসরি ইয়াবার চালান আসে মোশারফের নামে।
অভিযোগের বিষয়ে মোশার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে রূপগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, এখানে শেল্টার দেওয়ার কিছু নেই। মোশারফ মামলা খেয়েছে। জেলে গিয়েছে। জামিনও পেয়েছে। আইন আইনের গতিতে চলে। অন্যকারও গতিতে চলে না। সে রূপরগঞ্জের মানুষ। আমিও রূগঞ্জের মানুষ। এলাকার মানুষ হিসেবে তার স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার আছে। সে সেটাই করছে। যদি আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিণীর সদস্যরা যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।
রূপগঞ্জ থানার ওসি এএফএম সায়েদ বলেন, মোশারফের এলাকায় ফেরার সংবাদ পেয়েছি। তার নামে ওয়ারেন্ট আছে কিনা সেটা যাচাই করা হচ্ছে। এছাড়া পুলিশও সতর্ক রয়েছে। যদি সে আবারো কোনো অপকর্ম করার চেষ্টা করে তাহলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেব।