Logo
Logo
×

জাতীয়

আইডিয়ালের ৪ শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারীর নিয়োগ অবৈধ

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৩, ০৯:২৬ পিএম

আইডিয়ালের ৪ শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারীর নিয়োগ অবৈধ

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ

রাজধানীর মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে কর্মরত তিন জন সহকারী প্রধান শিক্ষকসহ ৪ শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারীর নিয়োগ অবৈধ। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) ২০২২ সালের এপ্রিল ও জুন মাসে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা করে এই তথ্য পেয়েছে। এই অবৈধ নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের মধ্যে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার সরকারি অংশ সরকারি কোষাগারে এবং নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের গ্রহণ করা বেতনভাতা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

গত ১৬ অক্টোবর পরিদর্শন ও নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে ডিআইএ। যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার, শিক্ষা পরিদর্শক মো. মুকিব মিয়া, সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক মনিরুজ্জামান, সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক সাদিয়া সুলতানা এবং অডিট অফিসার চন্দন কুমার দেব প্রতিবেদন তৈরি করেন।

এ বিষয়ে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার বলেন, গত ১৬ অক্টোবর প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। অবৈধ নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে যারা এমপিওভুক্ত তাদের নেওয়া বেতন-ভাতার সরকারি অংশ সরকারি কোষাগারে এবং যেসব শিক্ষক-কর্মচারী নন-এমপিও তাদের নেওয়া বেতন-ভাতার সমুদয় অর্থ উত্তোলন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ফান্ডে জমা করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। অবৈধ নিয়োগ পাওয়া জাল সনদ নিবন্ধন না থাকা শিক্ষকরা আত্মপক্ষ সমর্থনে মন্ত্রণালয়ে শুনানি চাইতে পারেন। এরপর মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেবে।

প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান বলেন, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিদর্শন প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে বলে শুনেছি। তবে প্রতিবেদন এখনও হাতে পাইনি। তাতে পেলে প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালের ৪ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কয়েক দফায় নিয়োগ দেওয়া হয় এসব শিক্ষক-কর্মচারীদের। এর মধ্যে ২০১১ সালে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৯৯ জন, ২০১৩ সালে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১৪৮ জন। গভর্নিং বডির বর্তমান সভাপতির সময় ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বিভিন্ন ব্রাঞ্চে নিয়োগ দেওয়া হয় ৮৯ জন। এছাড়া ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বনশ্রীতে ৬৯ জন এবং ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২১ সালে মুগদা শাখায় ৩৮ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে অবৈধভাবে নিয়োগ করা হয়েছে।

নিয়োগে অনিয়মের বিষয় তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালের ১৫ মার্চ থেকে ১৪ মে পর্যন্ত ১১১ জন শিক্ষক ও একজন ল্যাব অ্যাসিসটেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অনিয়মের মাধ্যমে। এসব শিক্ষকদের মধ্যে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন ৯৯ জন। বিভিন্ন ব্রাঞ্চে অস্থায়ীভিত্তিতে ৫৯ জন এবং ৪ জন ল্যাব সহকারী পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। কিন্তু পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির বাইরে অতিরিক্ত ৪২ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। অস্থায়ীভিত্তিতে নিয়োগ পেয়ে জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী এসব শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। অস্থায়ীভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হয় জাতীয় বেতন স্কেলে। প্রতিবেদনে ২০১১ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৯৯ জন শিক্ষককে দেওয়া বেতন-ভাতা ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

২০১৩ সালের ১৪২ জন শিক্ষক ও ৩ জন কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়, রেজুলেশনে ৯৪ জন শিক্ষক নিয়োগের কথা থাকলেও নিয়োগ দেওয়া হয় ১৪২ জন ও তিন জন কর্মচারীসহ মোট ১৪৫ জনকে নিয়োগ করা হয়। অর্থাৎ অতিরিক্ত নিয়োগ দেওয়া হয় ৫১ জন শিক্ষক-কর্মচারী।

বিধি মোতাবেক পদের নাম ও সংখ্যা উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার কথা কিন্তু তা করা হয়নি বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। এতে আরও বলা হয়, আর কর্মচারী নিয়োগে গভর্নিং বডির কোনও সিদ্ধান্তই ছিল না। ডিজির প্রতিনিধি মনোনয়নে কোনও পত্র জারি করা হয়নি। নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৩ সালের ২৩ মার্চ। ফলাফল শিটে প্রার্থীদের নিবন্ধন ও ইনডেক্স নম্বর লেখা নেই। ফলে সকল প্রার্থীর নিবন্ধন ও ইনডেক্স ছিল কিনা তা জানা যায়নি। বিধি অনুযায়ী ১৪৫ জন শিক্ষক-কর্মচারীর নিয়োগ বৈধ না হওয়ায় বেতন-ভাতা ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

গভর্নিং বডির বর্তমান সভাপতির সময় ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ৮৯ জন শিক্ষককে বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠান প্রধান কর্তৃক সরবরাহ করা শিক্ষক কর্মচারীদের নিয়োগ রেকর্ড যাচাই কারে দেখা যায়, শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ২০১৫ সালের ১১ নভেম্বরের মন্ত্রণালয়েরে পরিপত্র মানা হয়নি। যা অবৈধ নিয়োগ বলে বিবেচিত হবে। এসব শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত নন, তবে প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের বেতন ভাতা দেওয়া হয়েছে। এসব শিক্ষক কর্মচারীদের অর্থ প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

২০১৮ ও ২০১৯ সালে বনশ্রীতে ৬৯ জন এবং ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২১ সালে মুগদা শাখায় ৩৮ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে অবৈধভাবে নিয়োগ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র না মেনে এসব শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দেওয়া বেতন-ভাতা ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির সাব-অ্যাসিসটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. আতিকুর রহমান খানের ২০০৪ সালে ১২ অক্টোবরের নিয়োগও ছিল অবৈধ। নিয়োগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞপ্তিতে ১৫ দিন সময় দেওয়ার কথা থাকলেও মাত্র আট দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। আবেদনপত্র গ্রহণ ও যাচাই-বাছাইয়ের কোনও রেকর্ড নেই।  বিজ্ঞপ্তিতে অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছিল ৫ বছর। কিন্তু তার অভিজ্ঞতা ছিল চার বছর। তাছাড়া অন্য দুই প্রার্থীর অভিজ্ঞতা ছিল ৫ বছর। সুতরাং তার নিয়োগ বিধিমোতাবেক হয়নি। তাছাড়া জনবল কাঠামো অনুযায়ী পদটি প্যাটার্নভুক্ত নয় এবং তিনিও এমপিওভুক্ত নন। অথচ তিনি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ তহবিল থেকে ১০ কোডে এবং ১০ বছর পর ৯ কোডে বেতন গ্রহণ করেছেন। তার বেতন-ভাতা বাবদ ফেরতযোগ্য টাকার পরিমাণ ৩৮ লাখ ৫৩ হাজার ৯২০ টাকা।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গভর্নিং বডি সরকারি নির্দেশনা না মেনে শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগ দিয়েছেন তা বোধগম্য নয়।

প্রতিষ্ঠানটির অবৈধ নিয়োগ দেওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছেন তিন জন সহকারী প্রধান শিক্ষক। এরা হচ্ছেন—মুগদা শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম, বনশ্রী শাখার (বাংলা-দিবা শাখা) মোয়াজ্জেম হোসেন এবং মতিঝিল ক্যাম্পাসের (বাংলা-প্রভাতী শাখা) সহকারী প্রধান শিক্ষক মনিরুল হাসান।

মুগদা শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম শরীর চর্চা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান ১৯৯৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর, আর এমপিওভুক্তি হন ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর। এনটিআরসির সনদ ছাড়া তিনি ২০১১ সালের ১৫ মার্চ সমাজ বিজ্ঞানে পুনরায় নিয়োগ পান অস্থায়ীভিত্তিতে। সমাজ বিজ্ঞানে শিক্ষক নিবন্ধন সনদ না থাকায় নিয়োগ বিধিসম্মত হয়নি। শরীরচর্চা পূর্ব অভিজ্ঞতা দিয়ে সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে নিবন্ধন ছাড়া নিয়োগ বিধিসম্মত হবে না। প্রতিবেদনে ২৮ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা ট্রেজারি চালানে ফেরতের সুপারিশ করা হয়। এছাড়া তিনি ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ২০১৭ সালে বিএড সনদ গ্রহণ করেন মর্মে উল্লেখ করা হয়। ২০২১ সালের ২ মে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। অবৈধভাবে অন্যদিকে এমপিওভুক্ত না হওয়ায় এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ বিধিসম্মত না হওয়ায় প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ৩ লাখ ২২ হাজার টাকাও ফেরতের সুপারিশ করা হয়।

বনশ্রী শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন ১৯৯৬ সালের ১১ মে এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ যোগদান করেন ২০১৪ সালের ১১ জুন এবং ওইদিন থেকেই ৮ কোডে বেতন-ভাতা গ্রহণ করেন। তার বিএড সনদ জাল।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মোয়াজ্জেম হোসেন সাব অ্যাসিসটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. আতিকুর রহমানের আত্মীয়।

মতিঝিল ক্যাম্পাসের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক মনিরুল হাসান বর্তমানে বাংলা প্রভাতী শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক। সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল। ২০০৬ সালে বিএড সনদ নেন। তার পর রয়েল ইউনিভার্সিটির বিএড সনদ নেন ২০০৮ সালে। রয়েল ইউনিভার্সিটি তার সনদ জাল। জাল সনদ গ্রহণের জন্য তাকে জবাব দিতে হবে।

এছাড়া সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. ছালাম খান ছালাম খানের ১০১৭ সালে নিয়োগ বাতিল হয়। এই শিক্ষকও সাব-অ্যাসিসটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. আতিকুর রহমানের আপন ভাই। মামলায় চাকরি ফেরত পেলেও বকেয়া বেতন পাবেন না। অথচ তিনি ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত বেতন নিয়েছেন, ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে ৫ লাখ ৯৭ হাজার ২০০ টাকা ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম