স্বর্ণ আগেই গায়েব, গণনা শুরু হতেই চুরির সাজানো গল্প
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৫:০৬ পিএম
রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাস্টমসের ভল্ট থেকে ৫৫ কেজি স্বর্ণ গায়েবের ঘটনায় চুরির গল্প সাজানো হয়েছে বলে মনে করছেন সংস্থার কর্মকর্তারাই। বিশেষ করে গুদাম অটোমেশনের অংশ হিসেবে স্বর্ণ গণনা শুরুর পর বিষয়টি নজরে পড়ায় এমন সন্দেহ জোরদার হয়েছে।
তাদের ধারণা, সিসি ক্যামেরা না থাকায় গুদাম থেকে স্বর্ণ আগেই গায়েব হয়েছে। গণনায় বিষয়টি ধরা পড়ে যাবে- এমন ভাবনা থেকেই লকার ভেঙে ও টিন কেটে চুরির রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
স্বর্ণ জব্দ করার দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হস্তান্তরের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তিন বছর আগে আটক স্বর্ণও গুদামে রাখায় প্রশ্ন উঠেছে। খোয়া যাওয়া স্বর্ণগুলো ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের বিভিন্ন সময়ে জব্দ করা হয়েছিল। খোয়া যাওয়া স্বর্ণের দাম প্রায় ৪৫ কোটি টাকা।
বিমানবন্দরের সংরক্ষিত এলাকায় ঢাকা কাস্টম হাউসের গুদামের আলমারির লকার থেকে ৫৫ কেজি ৫১ গ্রাম স্বর্ণ গায়েবের বিষয়টি গত শনিবার ধরা পড়ে। তবে বিষয়টি জানাজানি হয় রোববার দুপুরে। এ ঘটনায় রোববার রাতে বিমানবন্দর থানায় চুরির মামলা করেছে কাস্টমস। মামলার এজাহারে বর্ণনায় কাস্টমসের আটজনের নাম রয়েছে। গুদামের চারজন নিরাপত্তাকর্মীকে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ।
স্বর্ণ চুরির বিষয়টি জানাজানির পর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, তদন্ত সংস্থা ও পুলিশের কর্মকর্তারা সোমবার গুদামটি পরিদর্শন করেছেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন আলামত সংগ্রহ করেছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, গুদামের ভেতরে কোনো সিসি ক্যামেরা নেই। ভেতরে রয়েছে ভেন্টিলেশন ও টিন; যা থাকার কথা নয়। সোনাগুলো বিশেষ ভল্টে না রেখে সাধারণ স্টিলের আলমারিতে রাখা হয়েছে। গুদামের নিরাপত্তা নীতিমালা ও নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়নি। বিমানবন্দরে জব্দ স্বর্ণ দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে হস্তান্তরের বাধ্যবাধকতাও মানা হয়নি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোর্শেদ আলম বলেন, আমরা গুদামটি পরিদর্শন করেছি। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা সিসিটিভির আওতায় ছিল না, এটি অবাক করার মতো। সবকিছুই আমরা তদন্ত করে দেখছি। গুদামে কোনো সিসি ক্যামেরা নেই। তাই সহজেই স্বর্ণ চুরি করতে পেরেছে।
জানতে চাইলে ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার নুরুল হুদা আজাদ বলেন, গত বছর সিসি ক্যামেরা কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে সরকারি কেনাকাটায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় বিষয়টি এগোয়নি। গুদামটি সিভিল এভিয়েশনের নির্মাণ করা। এটির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করার ক্ষমতা কাস্টমসের নেই। ভল্ট কেনা হয়েছে। তবে স্থাপনের আগেই এই ঘটনা ঘটেছে।
কাস্টমস কর্মকর্তা আরও বলেন, গুদামে কয়েকটি লকার থাকলেও স্বর্ণ চুরি হয়েছে একটি লকার থেকে। কয়েক দিন আগে গুদামে অটোমেশনের কাজ শুরুর পর এ ঘটনা ঘটল। অটোমেশন কাজের অংশ হিসেবে গুদামে থাকা স্বর্ণ গণনা শুরু হয়েছিল। স্বর্ণ আগেই চুরি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অটোমেশনের জন্য গণনায় সেটা ধরা পড়ে যাবে বলে লকার ভাঙার নাটক সাজানো হয়েছে।
২০২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সরকারের গেজেটে বলা হয়, গুদাম হবে কংক্রিটের। কংক্রিটের দেয়ালের পর ইস্পাতের ভল্ট থাকবে। এছাড়া সিসি ক্যামেরা, অ্যান্টি থেফট অ্যালার্ম সদর দপ্তরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। একটি প্রবেশ দরজা ও প্রবেশমুখে বডি স্ক্যানার থাকবে। তবে কাস্টমসের ওই গুদাম নির্মাণে এই নীতিমালা মানা হয়নি।
মামলার এজাহারে একটি ভেন্টিলেশনের টিনের কাটা অংশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে; যেখান থেকে চোর প্রবেশ ও বের হতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। তবে ওই সরু স্থান দিয়ে কোনো মানুষের পক্ষে ঢোকা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন কাস্টমস ও পুলিশের কর্মকর্তারা। এক্ষেত্রে দুই মাসের মধ্যে স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতাও মানা হয়নি।
ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার নুরুল হুদা আজাদ বলেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের গাফিলতি ছিল। এছাড়া একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে স্বর্ণ রাখতে হয়। পরীক্ষা করে স্বর্ণ জমা দিতে হয়, এ প্রক্রিয়া একটু দীর্ঘ।