গুম হওয়া সন্তানের মায়ের অশ্রুসজল আকুতি
ছেলে বেঁচে না থাকলে কবরের সন্ধান দিন
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৩, ০৮:৩৭ পিএম
অসহায় মায়ের আর্তি, ‘আমার ছেলে নিখোঁজ হওয়ার ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো প্রতীক্ষায় আছি। একমাত্র ছেলে ফিরে আসবে মায়ের কোলে। মা বলে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু সেই প্রতীক্ষা যেন আর শেষ হয় না।’ রাজধানীর তিতুমীর কলেজের ফাইন্যান্স বিভাগের ছাত্র আবদুল কাদের মাসুমের মা আয়েশা আলী কান্নায় চোখ ভিজিয়ে কথাগুলো বলছিলেন। মাসুমের মায়ের প্রশ্ন-‘এ প্রতীক্ষার অবসান কি কখনো হবে না? আমার ছেলে কি ফিরবে না? যদি ছেলে বেঁচে না থাকে তা হলে তার কবরের সন্ধান দিন।’ অঝোরে কান্নার সময় আয়েশা আলীর নাক দিয়ে এক পর্যায়ে রক্ত বের হয়ে আসে।
বুধবার সকালে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অডিটোরিয়ামে ‘আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস’ উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এভাবেই গুমের শিকার সন্তানের ফিরে না আসার কথাগুলো বলছিলেন মায়েরা। গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া অনুষ্ঠানটি চলে প্রায় তিন ঘণ্টা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ।
অনুষ্ঠানে গুমের শিকার হওয়া স্বজনদের ফিরে পাওয়ার আকুতিই ছিল সবার মুখে। তারা তাদের স্বজনের সঙ্গে বাঁচতে চান; তাদের দেখা পেতে চান। অনেক শিশু তার বাবার সঙ্গে খেলাধুলা করতে চায়। বাবার হাত ধরে স্কুলে যেতে চায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পরিবারের সদস্যরা অনুষ্ঠানে এভাবেই নিজেদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন।
গুমের শিকার সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা খাতুন বলেন, আজকে এত বছর হয়ে গেল দুই নাতিন নিয়ে আছি। ছেলের কোনো খোঁজ পাই না। আপনারা দোয়া কইরেন, মরার আগে যেন আমার ছেলেকে দেখে যেতে পারি।’
অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া প্রত্যেকের বুকে ঝোলানো ছিল নিখোঁজ স্বজনের ছবি। আবার কারও বুকে সন্তানের ছবি, কারও বুকে বাবার ছবি; কারও বুকে ভাইয়ের ছবি। অনুষ্ঠানে নিজেদের দুঃসহ কষ্টের কথা তুলে ধরেন তারা। কারও মা, কারও সন্তান, কারও বোন ঘটনার কষ্টকর বর্ণনা দেন। তারা প্রতিটি ঘটনাতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জড়িত থাকার অভিযোগ করেন।
অনুষ্ঠানে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘শেখ হাসিনার মনে কোনো মায়া-দয়া নেই। তার মন অনেক শক্ত। আমি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ করেছি, দেখেছি। এই কান্না তার কাছে যায় না। এমনকি স্বজন হারানোদের কোনো খোঁজও রাখেন না তিনি। এই সরকার যতদিন পর্যন্ত আছে ততদিন পর্যন্ত গুম হয়ে যাওয়া মানুষের কোনো খবর পাওয়া যাবে না। আপনারা কষ্ট পেতে পারেন। পাঁচ বছর আগেও এই কথা বলেছিলাম এবং আজও একই কথাই বলছি।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জুনায়েদ সাকি বলেন, বাংলাদেশ যে দেউলিয়া হতে যাচ্ছে এটা ঠেকানোর উপায় এই সরকারের নেই।
তিনি আরও বলেন, ‘এই সরকার বাসে আগুন দেওয়া, হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দেওয়া, মাদক ধরিয়ে দেওয়াসহ নানা ধরনের চক্রান্তের জালসহ সবকিছু করবে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে মানুষের শক্তি নিয়ে আমরা রাজপথে দাঁড়াব। আপনারা কেউ ভয় পাবেন না। কারণ ওই ভয় পাওয়ানোটাই তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।’
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘সব সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে সমাধান একজনের হাতে। তিনি অমরত্ব লাভ করার জন্য আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চান। এজন্য বিরোধী দল নির্মূল করার জন্য তার একটা টার্গেট থাকবেই। আগামী দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। তাই বিরোধী দলের যেসব ভাই রাজপথে আন্দোলন করছে তাদের এক থাকতে হবে। হয় লড়ো, না হয় মরো।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আমরা কোনো প্রতিশোধের রাজনীতি করি না। যারা খুনি, ডাকাত এবং প্রতিটি গুমের সঙ্গে দায়ী তাদের বিচার করা হবে। দেশকে আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক ধারায় নিয়ে যাব। সেই লড়াইয়ে আমরা গুম হওয়া পরিবারের সবার সঙ্গে ভাই-বন্ধু হিসাবে এগিয়ে যাব। আমরা আপনাদের সঙ্গে ছিলাম, আপনাদের সঙ্গে আছি এবং শেষ পর্যন্ত থাকব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মানুষকে গুম করা হয়েছে। অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য তাদের হত্যা করা হয়েছে। যারা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে তাদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য, বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য, বাংলাদেশের ব্যাংক লুটপাট করার জন্য এবং লাখো কোটি টাকা বিদেশে পাচার করার জন্য এই গুমগুলো করা হয়েছে। ভিন্ন মতের মানুষের মনে ত্রাস সঞ্চারের জন্য এসব করা হয়েছে। যদি আমরা গুমের বিচার চাই, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই তা হলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘নির্বাচন এলেই গুম-খুন শুরু হয়। যাদের গুম করা হয়েছে, তারা জীবিত থাকলে ছেড়ে দিন। আর জীবিত না থাকলে কবরের খোঁজ দিন।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন-বিএনপির মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ, গুমের শিকার আব্দুল বাসেদ মারজান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত সাবেক মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির স্থায়ী কমিটির সদস্য তানিয়া রব, মায়ের ডাকের সমন্বয়কারী আফরোজা ইসলাম আঁখি প্রমুখ।
আমাদের ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
খুলনা: গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষ্যে খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপির উদ্যোগে মুখে কালো কাপড় বেঁধে মৌন মিছিল ও সংক্ষিপ্ত সমাবেশ হয়। নগরীর কে.ডি ঘোষ রোডের দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন মহানগর বিএনপির আহবায়ক এড. শফিকুল আলম মনা। মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন এবং জেলা সদস্য সচিব মনিরুল হাসান বাপ্পির পরিচালনায় আরও বক্তব্য রাখেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমীর এজাজ খান, তারিকুল ইসলাম জহীর, আবু হোসেন বাবু, স ম আ রহমান, খান জুলফিকার আলী জুলু, এস এ রহমান বাবুল, কাজী মাহমুদ আলী, মো. রকিব মল্লিক, শের আলম সান্ট প্রমুখ।
ফরিদপুর: ফরিদপুর জেলা ও মহানগর বিএনপির উদ্যোগে এক মৌন মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোদাররেস আলী ইছার নেতৃত্বে শহরের কাঠপট্টিস্থ দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে মৌন মিছিল বের হয়। বক্তব্য রাখেন ফরিদপুর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব একেএম কিবরিয়া স্বপন, যুগ্ম আহ্বায়ক এমটি আখতার টুটুল, যুগ্ম আহ্বায়ক আবজাল হোসেন খান পলাশ, যুগ্ম আহ্বায়ক জুলফিকার হোসেন জুয়েল, যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আশরাফুল আলম নান্নু, মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব গোলাম মোস্তফা মিরাজ, মহানগর কৃষক দলের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ মামুন, জেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক রেজাউল করিম, জেলা যুবদলের সভাপতি রাজীব হোসেন, সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন, মহানগর যুবদলের আহ্বায়ক বেনজির আহমেদ তাবরীজ, জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক তানজিমুল হাসান কায়েস প্রমুখ।
কিশোরগঞ্জ: মুখে কালো কাপড় পরে বুধবার শহরে প্রতিবাদী মৌন মিছিল করেছেন কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। মিছিলে নেতৃত্ব দেন ও অংশ নেন কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি রুহুল হোসাইন, সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আমিনুল ইসলাম আশফাক, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি মো. বাহার মিয়া, জেলা যুবদলের সভাপতি খসরুজ্জামান শরীফ, জেলা ছাত্রদলের সভাপতি মো. মারুফ মিয়া প্রমুখ।