Logo
Logo
×

জাতীয়

অসচেতনতায় বাড়ছে পানিতে ডুবে মৃত্যু

Icon

শিপন হাবীব

প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২৩, ০৯:০৯ পিএম

অসচেতনতায় বাড়ছে পানিতে ডুবে মৃত্যু

প্রতীকী ছবি

মা ব্যস্ত গৃহস্থালি কাজে। আর গুটিগুটি পায়ে উঠোনে খেলায় মেতেছে এক বছরের শিশু সন্তান। উঠোনের পাশেই বালতি ভর্তি পানি। সেই বালতির পানিতে পড়েই প্রিয় সন্তানের অকাল মৃত্যু। ছোট্ট ফারিয়াকে পাশে নিয়েই কাজ করছিলেন মা। কখন সে তার কাছ থেকে উঠোনে চলে গেছে টের পাননি। ৩১ জুলাই মর্মান্তিক এ ঘটনা পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার সরকার পাড়ার। 

পঞ্চগড়ের দুর্ঘটনার একদিন পর নেত্রকোনার কলমাকান্দার সন্ধ্যাহালায় বাড়ির পাশের ডোবায় ডুবে মারা যায় দুই ভাইবোন তোফায়েল (৫) ও আফরোজা (৩)। বাড়ির লাগোয়া ডোবা থেকে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। কেবল নেত্রকোনাতেই দুই বছরে প্রায় ২২৫ শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে। 

পানিতে ডুবে কেবল শিশুরাই প্রাণ হারাচ্ছে এমনটা নয়, তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষই এভাবে অকালে প্রাণ হারান। ১ আগস্ট দুপুরে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) লেকে ডুবে মোবাশ্বেরা তানজুম ও তাসফিয়া জাহান নামের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। 

গবেষণা বলছে, প্রতিবছর পানিতে ডুবে শুধুমাত্র ৫ বছর বয়সি অন্তত ১১ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়। সব বয়সি মিলে এ সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ।

২৫ জুলাই ছিল বিশ্ব পানিতে ডোবা প্রতিরোধ দিবস। প্রতি বছরই ক্যালেন্ডার ধরে দিনটি আসে, চলেও যায়। দুনিয়াজুড়ে ফি বছরে একবার পানিতে ডোবা মৃত্যু প্রতিরোধ করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নানা আলোচনা হয়। তারপর যেমন চলার, সব চলে তেমনই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধ না হলে এসডিজি পূরণ হবে না। 

পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা বাড়লেও এর প্রতিরোধে পরিবার থেকে সমাজ বা রাষ্ট্রের কোনো উদ্যোগ চোখেই পড়ে না। সরকারি হিসাবেই দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সি শিশু মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ হচ্ছে পানিতে ডুবা। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি এক হাজার জীবিত জšে§ অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সি শিশু মৃত্যুর হার কমপক্ষে ২৫-এ নামিয়ে আনতে হবে। এমন বার্তার বিপরীতে পানিতে ডুবা মৃত্যুর সংখ্যা কমছে না-বরং সব বয়সি মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীববিজ্ঞান অনুষদের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. এসএম ইমামুল হক যুগান্তরকে বলেন, পানিতে ডুবে মৃত্যু বাড়ছেই। শিশুরা এর শিকার হচ্ছে খুব সহজে। সমাজের এ নিয়ে কোনো বার্তা নেই। প্রচার-প্রচারণা নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ঘরের অন্দর মহলেও এমন মৃত্যু প্রতিরোধের কোনো উদ্যোগ নেই। সামাজিকভাবে এমন মৃত্যু প্রতিরোধ করতে হবে।

ড. ইমামুল হক আরও বলেন, এমন করুণ মৃত্যু রোধে সবচেয়ে জরুরি জনসচেতনতা। পানিতে ডুবে মৃত্যু, অসচেতনতাই কাল। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের ক্লাস শেষে এ নিয়ে আলোচনা করা উচিত। শিশুদের সাঁতার শেখা বাধ্যতামূলক করা উচিত। ‘বাধ্যতামূলক’ এ শিক্ষায় নিশ্চয় সবার মঙ্গল হবে। এসডিজিও বাস্তবায়ন হবে। 

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা স্থানীয় থানায় খুব একটা জানানো হয় না। ফলে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা জানা যায়নি। দেশে পানিতে ডুবে মৃত্যুর সর্বশেষ দেশব্যাপী জরিপ হয়েছিল ২০১৬ সালে। ‘বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভের তথ্যানুযায়ী প্রতিদিন অনূর্ধ্ব-৫ বছর বয়সি ৩০ শিশুর মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। বছরে এ সংখ্যা দাঁড়ায় অন্তত ১১ হাজারে। শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর ৮০ ভাগ ঘটনা ঘটে বাড়ির ২০ গজের মধ্যে।  

জনস্বাস্থ্যবিদ ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, শিশুরা নিজ ঘর, ঘরের আঙ্গিনায়, গোসলখানায় পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। বালতি-গামলার পানিতে পরেও শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধ না হলে এসডিজির লক্ষ্য অর্জিত হবে না। প্রান্তিক-শ্রমজীবী মানুষের সন্তানরা সবচেয়ে নিরাপত্তাহীনতায় থাকে। এদের শিশুর জন্য সরকার-রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। 

মুশতাক হোসেন আরও বলেন, শিশুদের ক্ষেত্রে মায়েরা কোমরে বেল্ট লাগিয়ে সেই বেল্টে শিশুকে বেঁধে রাখতে পারেন। বালতি বা গামলায় কখনও পানি ভরে রাখা যাবে না। আশপাশের ডোবার পাড়ে বেষ্টনী দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার কাজটি করে দিতে পারে। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে সর্বোচ্চ প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারে।  

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে ১০টি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে। এর মধ্যে রয়েছে সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন, সব শিশুদের সাঁতার শেখানো, প্রাথমিক চিকিৎসা প্রভৃতি। একই সঙ্গে এ ব্যবস্থার পাশাপাশি ডুবে মৃত্যু রোধে একটি জাতীয় কর্মপন্থাও তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু দেশে জাতীয় কর্মপন্থা এখনো তৈরি হয়নি। 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম