নারকোটিক্সের অভিনব তালিকা
চুনোপুঁটি নিয়ে টানাটানি রাঘববোয়ালরা বাদ
মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস আজ
তোহুর আহমদ
প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৩, ০৯:৫৪ এএম
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর
আজ মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর দিবসটি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। দিবসটিকে সামনে রেখে জোরদার করা হচ্ছে মাদকবিরোধী অভিযান। এজন্য সারা দেশের প্রায় ৭০ হাজার মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তালিকাটি সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু তালিকায় রাঘববোয়াল মাদক ব্যবসায়ী কারও নাম নেই।
বহুল আলোচিত কক্সবাজারের সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদি কিংবা রাজশাহীর এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর নাম যুক্ত করার সাহস দেখাতে পারেনি অধিদপ্তর। অথচ দুবছর আগে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সরকারের কাছে যে বিশদ তালিকা দেওয়া হয় সেখানে উল্লেখিত দুজন প্রভাবশলীসহ রাঘবোয়াল অনেকের নাম আছে। যদিও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আর এবার তাদের নাম মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হলো।
পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, এই যদি হয় মাদক নিয়ন্ত্রণের জোরদার অভিযানের চিত্র, তাহলে দেশকে মাদকমুক্ত করা শুধু স্লোগান ছাড়া আর কিছুই হবে না।
দেখা যায়, মোট ৭০ হাজার নাম তালিকাভুক্ত করেছে নারকোটিক্স। এদের বেশিরভাগই মৌসুমি মাদক ব্যবসায়ী। কেউ কেউ খুচরা গাঁজা বিক্রেতা। কেউবা বাহক। অথচ খোদ নারকোটিক্স কর্মকর্তারাই বলছেন, তালিকায় ৭০ হাজার নাম থাকলেও বাস্তবে এ সংখ্যা ৫ লাখের কম নয়। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সবার নাম তালিকাভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। প্রভাবশালীদের অনেকেই তালিকার বাইরে আছেন। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের শেল্টারে থাকা মাদক ব্যবসায়ীরা আছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ঢাকার পরিস্থিতি জটিল : তালিকা অনুযায়ী ঢাকায় মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। এর মধ্যে বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, উত্তরা, মতিঝিলসহ কয়েকটি এলাকা মাদকপ্রবণ হিসাবে চিহ্নিত। রাজধানীর জেনেভা ক্যাম্প, ফার্মগেট, কাওরান বাজার, বাসাবো ও খিলগাঁও এলাকার কয়েকটি জায়গায় প্রকাশ্যে মাদকের হাট বসে। এসব জায়গা থেকে নারকোটিক্স ও পুলিশ নিয়মিত মাসোহারা আদায় করে থাকে।
নারকোটিক্সের তালিকায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মাদক গডফাদারদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অথচ বাস্তবে এদের কেউই তেমন বড় মাপের মাদক ব্যবসায়ী নেন। কেউ কেউ এলাকায় ভাসমান। আবার কেউ খুচরা ইয়াবা এবং গাঁজা বিক্রেতা। যেমন মেরুল বাড্ডার মাদক গডফাদার হিসাবে তালিকায় নাম আছে মো. লালন, পিতা মৃত আব্দুর রহমান এবং মাতা মৃত রেনুফা বেগম। তার গ্রামের বাড়ি ভোলোর পশ্চিম ইলিশা। রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকার বইটাখালি থানা রোডে (নুরুল ইসলাম মিয়ার বাসা) দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করেন তিনি।
যুগান্তরের পক্ষ থেকে মেরুল বাড্ডা এলাকায় মাদক গডফাদার হিসাবে লালনের খোঁজ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে লালনের খোঁজ মেলেনি। স্থানীয়রা জানান, লালন নামের একজন ভাসমান মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু বেশ কয়েক বছর আগেই তিনি এলাকাছাড়া।
একইভাবে মতিঝিল ও শাহজাহানপুর এলাকায় মাদক গডফাদার হিসাবে নাম আছে যথাক্রমে আল আমিন, পিতা মৃত আনু মোল্লা ও রুবেল হোসেন পিতা মৃত বাবুল হোসেন। এদের মধ্যে আল আমিনের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে এবং রুবেলের গ্রামের কুমিল্লার মুরাদনগর। কদমতলী এলাকার গডফাদার হিসাবে হাসান আলীর ছেলে মো. ফয়সালের নাম আছে তালিকায়। তার বর্তমান ঠিকানা-১৭৫৩, কদমতলী জনতাবাগ। যাত্রাবাড়ী এলাকায় গডফাদার হিসাবে তালিকাভুক্ত মো. চাঁন মিয়া। তার পিতার নাম মৃত আব্বাস আলী, মাতা আজিরন বেগম। তিনি রায়েরবাগ আলী আমিনের বাড়ির ভাড়াটিয়া। কমলাপুর এলাকায় তালিকাভুক্ত মো. হুমায়ুন, পিতা দিপু শেখ, মাতা সালেহা বেগম। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী বেতবাড়িয়া। তুরাগ এলাকার মাদক গডফাদার বলা হচ্ছে মো. হারুনুর রশীদকে। তার পিতার নাম মৃত আব্দুল জলিল, গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল। তালিকায় শেরেবাংলানগর এলাকার গডফাদার হিসাবে আছে হাজি ইলিয়াস মিয়ার ছেলে রায়হান উদ্দিনের নাম। তার ঠিকানা ৪৩/ভি, ইন্দিরা রোড। গুলশান এলাকায় মাদক গডফাদার হিসাবে তালিকাভুক্ত কাজল রোজারিও। তার পিতার নাম মৃত রুবেল রোজারিও, গ্রামের বাড়ি পাবনা চাটমোহরের খারবাড়িয়া।
ওয়ারীতে মৃত মইজ উদ্দিন প্রধানের ছেলে আব্দুর রশিদকে গডফাদার বলা হচ্ছে। তার গ্রামের বাড়ি মানিগঞ্জের দৌলতপুরের জিয়ানপুর, নারানদিয়া। ডেমরা এলাকার মাদক সম্রাজ্ঞী হিসাবে তালিকাভুক্ত মিলি বেগম ওরফে পুতুল। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি। ভাষানটেক এলাকায় মাদক গডফাদার হিসাবে চিহ্নিত জনৈক আনোয়ার হোসেন। তার পিতার নাম আবদুল সাত্তার খান। বর্তমান ঠিকানা-১১৫, মজুমদারবাড়ীর মোড়, থানা-ভাষানটেক। মোহাম্মদপুর বছিলা এলাকায় মাদক গডফাদার হিসাবে তালিকাভুক্ত মো. জসিম উদ্দিন। তার পিতার নাম আলী বেপারী এবং মায়ের নাম রেনু বেগম। তার বর্তমান ঠিকানা-১২৪/১২/১, ওয়েস্ট ধানমন্ডি হাউজিং, বসিলা, মোহাম্মপুর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাদক ব্যবসার প্রবণতা শহর কেন্দ্রীক। রাজধানী ঢাকাও এর বাইরে নয়। পুলিশের অপরাধ তথ্যভান্ডার (সিডিএমএস) অনুযায়ী গত পাঁচ বছরে ঢাকা বিভাগে দায়েরকৃত মামলার ৪৬ শতাংশই মাদক মামলা। এছাড়া দেশের সব কারাগারে মোট বন্দির ৭০ শতাংশ মাদক সংশ্লিষ্ট মামলার আসামি। ইতোমধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ছড়িয়ে পড়ছে মাদকের বিষবাষ্প। মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। ডোপ টেস্টের আওতায় আনার পর একাধিক পুলিশ সদস্যকে চাকরিচ্যুত করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
ক্রয়ফায়ার ফর্মুলা কাজে আসেনি : প্রায় ২ বছর ধরে টেকনাফ ও কক্সবাজার অঞ্চলে বিশেষ মাদকবিরোধী অভিযান চালানো হলেও সুফল মেলেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রসফায়ারে গডফাদারদের অনেকে নিহত হলেও থেমে নেই মাদক ব্যবসা। মাদক গডফাদার হিসাবে নতুন অনেকের নাম উঠে এসেছে তালিকায়।
চলতি বছরে শুরুতে র্যাবের পক্ষ থেকে টেকনাফ শহরকেন্দ্রিক মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা করা হয়। এতে মোট ২৩১ জনের নাম উঠে আসে। এর মধ্যে পুরান পল্লানপাড়া এলাকাতেই তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী ৪৩ জন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মৃত হাসান আলীর ছেলে নুরুল বশর, আবু হরেশের ছেলে জিয়াউর রহমান, নুরুল হকের ছেলে কায়সার মাহফুজ, আবু তাহেরের ছেলে আব্দুল জব্বার, ধইল্ল্যা মিয়ার ছেলে সফিউল্ল্যাহ, দিল মোহাম্মদের ছেলে আব্দুল মাজেদ এবং আশিক উল্লাহর ছেলে মো. তাসিল। এছাড়া শহরের চৌধুরীপাড়ায় তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী আছেন অন্তত ২০ জন। এদের মধ্যে আব্দুস সাত্তার, পিতা আব্দুল মতলব, সাহাব উদ্দীন, সফিম, পিতা আক্তার আহম্মদ, আলম, পিতা মৃত মোজাহার মিয়া ও সলিম, পিতা মৃত জালাল অন্যতম।
র্যাবের তালিকা অনুযায়ী টেকনাফ শহরের জালিয়াপাড়ায় মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রায় ৩০ জন পেশাদার মাদক ব্যবসায়ীর নাম আছে এ তালিকায়। এদের মধ্যে মৃত দলিলুর রহমানের ছেলে সালমান, সামসুর ছেলে রুবেল, ইউনুসের ছেলে খোকন, এজাহার মিয়ার ছেলে ফয়সাল, সফিক এবং সৈয়দ নুরের ছেলে নুরুল বশর অন্যতম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজারকেন্দ্রিক মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকেই ইয়াবাকে মাদক মনে করে না। র্যাবের কাছে আত্মসমর্পণকারী কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী তাদের জবানবন্দিতে বলেন, ‘এটা (ইয়াবা) ওষুধ। শরাব (মদ) পান করা ইসলামে হারাম। কিন্তু ওষুধ খাওয়া হারাম নয়। অর্থাৎ ইয়াবার ভয়াবহতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকায় মাদক ব্যবসার পথ থেকে ফেরানো যাচ্ছে না তাদের। তবে সরকার ইতোমধ্যে মাদক নির্মূলে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। এছাড়া সমন্বিত পরিকল্পনা ও অভিন্ন কর্মপদ্ধতি নির্ধারণের কথা বলা হচ্ছে। সম্প্রতি রাজধানীতে এক মাদকবিরোধী সভায় স্বরাষ্টমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘জঙ্গিবাদ যেভাবে নির্মূল করা হয়েছে, ঠিক সেভাবে মাদকের বিরুদ্ধেও আমাদেরকে জয়লাভ করতে হবে।’