ছবি: সংগৃহীত
করোনার সময় সাধারণ ধারণার চেয়ে ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে দরিদ্র কম ছিল। শুধুমাত্র ঢাকা শহরে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দরিদ্র কমেছে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। একই সময়ে অতি দরিদ্রতা কমেছে ৩ দশমিক ২ শতাংশ।
এ দরিদ্র কমার অন্যতম কারণ হচ্ছে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি, মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রমে অংশগ্রহণ ও ডিজিটাল অর্ন্তভূক্তির, সঞ্চয় ভেঙে খাওয়া এবং সরকারি-বেসরকারি সহায়তা। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক নানাবিধ কর্মকাণ্ডের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় মানুষ কিছু না কিছু করেছে। তবে শহরে মোট দরিদ্রের প্রায় ৫১ ভাগ ছিল নতুন দরিদ্র।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) দুই দিনব্যাপী বার্ষিক গবেষণা সম্মেলনের (বিআইডিএস রিসার্স অ্যালামনাক-২০২৩) প্রথম দিন এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। বুধবার রাজধানীর লেকশোর হোটেলে এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে বিআইডিএস।
সংস্থাটির মহাপচিালক ড. বিনায়ক সেনের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা সচিব সত্যজিত কর্মকার। প্রথম দিনে প্রায় ১০ টি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়।
ড. বিনায়ক সেন বলেন, করোনার সময়ে দ্ররিদ্রতা বাড়লেও সেটা ছিল সাময়িক। পরবর্তীতে এটা কমতে শুরু করে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত দরিদ্র বেড়েছিল। জুনের পর সেটি কমতে শুরু করে পরবর্তীতে স্বাভাবিকের জায়গায় চলে যায়। এ দরিদ্রতা কমার ক্ষেত্রে গুরুপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে। তবে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য এখনো আছে। এটা কমাতে হলে বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই।
‘আরবান প্রভার্টি ডায়নামিস ডিউরিং কোভিড-১৯: অ্যানাটমিক অব রেজিলিয়েন্স’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন ড. বিনায়ক সেন।
এতে বলা হয়েছে, প্রাক-কোভিড স্তর থেকে বলা হয়েছিল দারিদ্র্য দিগুণ হয়েছিল। সেটি সেটি ঠিক নয়। ওই সময় প্রাক-কোভিড স্তরের নিচে নেমে গিয়েছিল। পরবর্তীতে অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। ঢাকা মেগাসিটিতে দরিদ্র্য কমেছে। ২০১৯ এবং ২০২২ এর মধ্যে সামগ্রিক দরিদ্রের সংখ্যা কমেছে।
কোভিড-১৯-এর চাপ থাকলেও দরিদ্র হ্রাসে এটি একটি উলে¬খযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়। তবে ঢাকার মতো উচ্চ বর্ধনশীল মেগাসিটিতে শহুরে দীর্ঘস্থায়ী দরিদ্র এখনো যথেষ্ট। শহুরে জনসংখ্যার প্রায় এক-দশমাংশ এই শ্রেণীর অন্তর্গত। করোনার ফলে উদ্ভূত একটি নতুন সামাজিক হিসাবে কিছু মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছিল। এটি মোট দারিদ্রের প্রায় ৫১ ভাগ ছিল নতুন দরিদ্র।
গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড-১৯ এর কঠিন সময়ে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি, কন্যাদের জন্য বয়ঃসন্ধিকালের বিয়ের হার বা সমাজে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে করোনার কোনো উল্লেখযোগ্য বিরূপ প্রভাব পাওয়া যায়নি।
তবে কালো মেঘ অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে। চরম দরিদ্র পরিবারের ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ রিপোর্ট করেছে যে তাদের করোনা মহামারি চলাকালীন ছেলে বা মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ করতে হয়েছে। এটি দরিদ্রের জন্য ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
নিম্ন মধ্যবিত্তের জন্য ১০ দশমিক ৩ শতাংশ এবং উচ্চ মধ্যবিত্তের জন্য ৮ শতাংশের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। করোনার সময়ে শিক্ষামূলক মানবিক পুঁজির বিকাশের ক্ষেত্রে শহুরে দরিদ্রতম শ্রেণি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিআইডিএসের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, করোনার আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালে দরিদ্র মানুষের মধ্যে আত্মকর্মসংস্থানের হার ছিল ৩৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। করোনার পর অর্থাৎ গত বছর সেটি বেড়ে ৩৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ হয়েছে।
অন্যদিকে অতিদরিদ্র মানুষের মধ্যে করোনার আগে আত্মকর্মসংস্থানের হার ছিল ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। করোনার পর সেটি বেড়ে ৩৩ দশমিক ২১ শতাংশে দাঁড়ায়। এ ছাড়া ২০১৯ সালে দরিদ্র খানা বা পরিবারের মধ্যে ৩৯ দশমিক ২৯ শতাংশ এমএফএস (মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস) ব্যবহার করত।
করোনার পর অর্থাৎ ২০২২ সালে সেটি বেড়ে ৭৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ হয়েছে। করোনার আগে ৩২ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবারের ব্যাংক হিসাব ছিল। পরে সেটি বেড়ে হয়েছে ৩৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
এদিকে অতিদরিদ্র পরিবারের মধ্যে ২০১৯ সালে ১৫ দশমিক ১৫ শতাংশ এমএফএস ব্যবহার করত। করোনার পর সেটি বেড়ে ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ হয়েছে।
সম্মেলনে অপর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশে ৩০ লাখ মানুষকে নতুন করে দরিদ্রতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এর প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, সার এবং অপরিশোধিত তেলের দাম। যার প্রভাব পড়েছে দেশে। এ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জাতীয় কল্যাণ ২ শতাংশ কম হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের কৃষি খাত। ভর্তুকিতে সার বিক্রি উৎপাদনকে বাড়িয়েছে। কিন্তু তার থেকে সঠিক পন্থা ছিল দরিদ্রতা কমানোর জন্য নগদ অর্থ দেওয়া।
২০২২ সালের প্রথম দিকে পেট্রোলিয়ামের দাম বাড়তে থাকে। শুধুমাত্র ২০২১ সালের জুলাই মাসে বাড়ানো হয়েছিল। তবে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু হওয়ার কয়েক মাস পরে ২০২২ সালে জুলাইয়ে এ হার আরও বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন সারের দামও ব্যাপক বেড়ে যায় কিন্তু দেশে দাম কম ছিল ভর্তুকির ফলে। ফলে সরকারের ওপর অতিরিক্ত বোঝা সৃষ্টি করে।
২০২১ সালের মাঝামাঝিতে খাবারের দাম ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে। চাল, গম, ভুট্টা এবং ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক মূল্য বৃদ্ধির ফলে ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত আমদানি ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু ২০২২ সালের মে থেকে এ পণ্যগুলোর দাম কমলেও দেশীয় বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতি প্রবণতা রয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে বিনিময় হারের অবমূল্যায়ন হয়েছে।
অন্য একটি গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের শ্রম বাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও তা এখনো কাঙ্ক্ষিত নয়। নারীরা গৃহস্থালির কাজে বেশি যুক্ত থাকায় তাদের অন্যক্ষেত্রে দক্ষতা তৈরি হচ্ছে না। ফলে তারা পিছিয়ে যাচ্ছে।