গণিতশাস্ত্রের উৎপত্তির পর থেকে একুশ একটি সংখ্যা। কিন্তু বাঙালির ভাষা আন্দোলন সেই সংখ্যাকে বাঙালি জাতির জীবনে একটি প্রত্যয় হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এটি আমাদের জীবনে সাধারণ কোনো সংখ্যা বা তারিখ নয়। এ সংখ্যাটির আগে ‘অমর’ যুক্ত করে আমরা আমাদের জাতিসত্তার ইতিহাসের সঙ্গে একুশের চেতনাকে একীভূত করেছি। তাই অমর একুশের চেতনা বাঙালি জাতির গৌরবদীপ্ত সূচক।
আমরা আমাদের এই দীপশিখাকে চির অম্লান রেখে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বহন করে চলেছি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একুশ এমন একটি গভীর সত্য, যা আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করে। আমাদের ইতিহাস নির্মাণে ভুল হয় না। বায়ান্ন থেকে শুরু করে আমরা যে কোনো গভীর সংকটে-সংগ্রামে যথাযথ দায়িত্ব পালন করে এ সত্য প্রমাণ করেছি। সুতরাং একুশের চেতনা আমাদের জীবনে অবিনাশী আয়োজন। একুশকে কেন্দ্র করে যে বইমেলা উদ্যাপিত হয়, তা আমাদের সাংস্কৃতিক নির্মাণকে গতিদান করে। একুশের প্রতিভূ শহিদ মিনার আমাদের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার তীর্থভূমি।
আমরা প্রয়োজনে শহিদ মিনারে গিয়ে শপথ গ্রহণ করি। আজকের জঙ্গি উত্থানের পটভূমিতে একুশের চেতনাই আমাদের প্রতিরোধের হাতিয়ার। এভাবেই যতদিন বাঙালি জাতি থাকবে, বাংলাদেশ থাকবে, শহিদ মিনার থাকবে এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার সমুন্নত থাকবে-ততদিন একুশের চেতনাও আমাদের জাতিসত্তার বুকের গভীরে থাকবে। এ দেশ থেকে নির্মূল হবে জঙ্গিবাদ।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সাতচল্লিশ বছর পর অমর একুশের দিনটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর এমন একটি ঘোষণার দিন। প্রশ্ন হলো, পরবর্তী বছরগুলোয় আমরা কি তেমন কিছু অর্জন করতে পেরেছি? এ বছর ভাষা আন্দোলনের একাত্তর বছর পূর্ণ হলো। মার্চে স্বাধীনতার ৫২ বছর পূর্ণ হয়েছে। এটি কোনো ক্ষুদ্র সময় নয়। মহাকালের হিসাবে ক্ষুদ্র সময় হলেও একটি জাতির জীবনে দীর্ঘ সময়। এ সময়ে আমরা যতটা কথা বলেছি, ততটা কাজ করিনি। জীবনের সর্বক্ষেত্র নির্মাণের জায়গাগুলো আমরা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি। বলা যায় প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, সেই সঙ্গে বাংলা ভাষাও, যে ভাষার মর্যাদার জন্য আমাদের জীবন দান।
সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বস্তরে বাংলা ভাষা স্বীয় মর্যাদায় আসীন এ কথা বলা যাবে না। পরিস্থিতি এমন যে, সর্বগ্রাসী বাণিজ্যিক মানসিকতা মাতৃভাষাকে প্রান্তিক করে ফেলেছে। দেশের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে। তারা না দেয় মাতৃভাষার মর্যাদা, না বোঝে আত্মমর্যাদার ধারণা। হীনম্মন্য মানসিকতার তোড়ে ভেসে যায় তাদের শিকড়হীন জীবনের বিলাসিতা।
ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা। এই ভাষা শেখা নিয়ে কারোই এখন দ্বিমত নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য ইংরেজি জানা প্রয়োজন। আমার প্রশ্ন : এই ইংরেজি জানার জন্য মাতৃভাষার অবমাননা হতে দেওয়া উচিত কি?
বেশ কিছুদিন আগে একজনকে বলেছিলাম, মেয়েকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াচ্ছ, ঠিক আছে; কিন্তু মেয়েটি ওর মাতৃভাষা জানবে না কেন? তুমি যে ওকে ওর মাতৃভাষা শেখা থেকে বঞ্চিত করছ, তাতে ওর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে না? তুমি কি ওকে ওর আইডেনটিটি বোঝার চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করছ না? যাকে কথাগুলো বলেছিলাম সে চুপ করে ছিল। মুক্তিযুদ্ধে জীবন দেওয়া শহিদ পরিবারের এই প্রজন্মের শিশুরা স্বাধীন বাংলাদেশে এভাবে বড় হচ্ছে। আমি তাকে আরও বলেছিলাম, এই বাংলাদেশের জন্য কি তোমরা যুদ্ধ করেছিলে? সে চুপ করেই ছিল।
স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর পর দেখেশুনে মনে হয়, গ্রামের নিরন্ন সাধারণ মানুষই নিজ মাতৃভাষাকে অবমাননা না করেই জনজীবনের শক্তি হিসাবে ধরে রেখেছে। সিডরে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণের সময় দেখেছিলাম, একজন নারী তার স্বামীকে দেওয়া কার্ডটি নিয়ে এসেছে। নির্দিষ্ট দিন ত্রাণ বিতরণের আগে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের শনাক্ত করে কার্ড দেওয়া হয়েছিল। সেই নারীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কার কার্ড নিয়ে এসেছেন? এ কার্ডে তো আপনার নাম নেই? তিনি অবলীলায় বলেছিলেন, মোর গেরস্তের। অসুখ। আইতে পারে নাই।
গেরস্ত শব্দটি শুনে চমকে তার দিকে তাকাই। বুঝতে পারি তিনি প্রমিত বাংলার শব্দ স্বামী বাতিল করে দিয়ে তার নিজের ভাষায় উত্তর দিয়েছেন। ওই আঞ্চলিক শব্দটি তার মাতৃভাষা। আমি শহর থেকে গেছি। আমার সঙ্গে ভাষা গুছিয়ে বলতে হবে, এই বিশ্বাসই তার নেই। প্রমিত বাংলা ভাষা তার রাষ্ট্র তাকে শেখার সুযোগ করে দেয়নি। তাই বলে তার মাতৃভাষা নিয়ে তার কোনো দ্বিধা বা সংকোচ নেই।
দেখা যাক, ভাষা আন্দোলনের শহিদদের পরিচয় এবং তার সঙ্গে সামাজিক ভাবনার জায়গা। যারা শহিদ হয়েছেন তাদের মধ্যে একমাত্র বরকত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রফিক ছিলেন প্রেসের কর্মচারী, সালাম সচিবালয়ের পিওন, জব্বার কৃষক, অহিউল্লাহ কাঠমিস্ত্রির ছেলে এবং শফিউর রহমান হাইকোর্টের কর্মচারী।
ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিলেন, তারা প্রত্যেকে ছিলেন বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষার মানুষ। বেশির ভাগই ছিলেন সাধারণ মানুষ। তাদের পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করেনি, মাতৃভাষার অমর্যাদা করেনি। বরং ভাষার পক্ষে প্রবল জনশক্তি হয়ে টিকে আছে। প্রয়োজনে আবার জীবন দেবে।
ফেব্রুয়ারি এলে এসব কথা লিখব আর আক্ষেপ করব-এই নিয়তিই কি আমার প্রজন্মের এবং আগামী প্রজন্মের? নাকি এমন দিন দ্রুত ঘনিয়ে আসবে যখন মাতৃভাষার জন্য কেউ আফসোস করবে না? নাকি বাংলা ভাষার ইতিহাস রক্ষা করার জন্য আবার জীবন দিতে হবে?
ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ একটি প্রত্যয়দীপ্ত সময়। তারপরও স্বাধীন দেশে ভাষার মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন কেন? এখনই সময় নিজেদের অবস্থান খতিয়ে দেখার। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে জনজীবনের সর্বত্র মাতৃভাষাকে সমুন্নত করার।
সেলিনা হোসেন : কথাসাহিত্যিক; সভাপতি, বাংলা একাডেমি