নিউজ পোর্টালের র্যাংকিং নিয়ে বিভ্রান্তি, ফেসবুকে তোলপাড়
প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৩, ০৪:৪৫ পিএম
নিউজ পোর্টাল র্যাংকিং। ছবি: সংগৃহীত
অনলাইন নিউজ পোর্টালের র্যাংকিং নিয়ে বড় ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি কতিপয় অসাধু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিজেদের স্বার্থরক্ষায় মনগড়া র্যাংকিং প্রকাশ করায় এ নিয়ে বিভ্রাটের সৃষ্টি হয়েছে। তৃতীয় কোনো পক্ষের কাছ থেকে ডাটা নিয়ে এবং কোনো ধরনের রিসার্চ মেথডোলজি (গবেষণা পদ্ধতি) প্রকাশ না করেই এসব প্রতিষ্ঠান র্যাংকিংয়ের তালিকা প্রকাশ করছে। এতে পাঠক ও বিজ্ঞাপনদাতাদের মধ্যে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে।
১৭ জানুয়ারি ‘মিডিয়া সার্ভে’ নামে কথিত একটি জরিপ সংস্থা বাংলাদেশের অনলাইন মিডিয়াগুলোর র্যাংকিং প্রকাশ করে। রিপোর্টটি প্রকাশ হওয়ার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এই রিপোর্ট দেখে বেশিরভাগ অনলাইন গণমাধ্যমকর্মী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
প্রতিষ্ঠানটি কোন পদ্ধতি অবলম্বন করে জরিপ করেছে সেটি উল্লেখ করেনি। তাদের গবেষণার ভিত্তি কী, সেটিও উল্লেখ নেই। মিডিয়া সার্ভে তাদের ওয়েবসাইটে যোগাযোগের যে নম্বর দিয়েছে সেটিও সঠিক নয়। বাংলাদেশের অনলাইন গণমাধ্যমের শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিরা জরিপকারী প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। স্বার্থান্বেষী এ চক্রের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টিও সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।
ওয়েবসাইটের গ্লোবাল র্যাংকিং নির্ধারণী টুল ‘অ্যালেক্সা ডটকম’ বন্ধ হয়ে গেছে গত বছরের ৩০ এপ্রিল। কনটেন্ট রিসার্চ, অ্যানালাইসিস, কি-ওয়ার্ড খুঁজে বের করা ও অন্যান্য কাজে ২৫ বছর ধরে সহায়তা করে আসছিল এ টুল। অ্যামাজনের এ সার্ভিসের কোনো কোনো বিষয় নিয়ে আপত্তি থাকলেও গ্রহণযোগ্যতা ছিল।
অ্যালেক্সা ডটকম বন্ধ হয়ে যাওয়ার সুযোগে মিডিয়া সার্ভেসহ কিছু প্রতিষ্ঠান অনলাইন গণমাধ্যমগুলোর র্যাংকিং প্রকাশ করছে। অ্যালেক্সা যেসব প্রতিষ্ঠানের র্যাংক করত তাদের ওয়েবসাইটে অ্যালেক্সার কোড বসানো থাকত। কিন্তু এখন যারা র্যাংকিং করছে তাদের কোনো কোড নেই ওয়েবসাইটগুলোতে। এ কারণে তাদের জরিপ করার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
সিমিলার ওয়েব নামে মার্কিন একটি প্রতিষ্ঠান ওয়েবসাইটগুলোর র্যাংক করে। তাদের দাবি, তারা ওয়েবসাইটগুলোর ফেসবুক পেজ ও গুগল অ্যানালাইটিকস থেকে ডাটা নিয়ে থাকে। সিমিলার ওয়েব ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সবশেষ র্যাংকিং প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নিউজ সাইটগুলোর মধ্যে প্রথম আলো ১ নম্বরে, যুগান্তর দুই নম্বরে, কালের কণ্ঠ তিন নম্বরে, বিডিনিউজ ৪ নম্বরে এবং জাগো নিউজ ৫ নম্বরে। এই তিন মাসে ভিজিটরের দিক থেকেও একই ক্রমে আছে উল্লিখিত পোর্টালগুলো।
কথিত জরিপকারী প্রতিষ্ঠান মিডিয়া সার্ভের দাবি, তারা সিমিলার ওয়েবের ডাটা নিয়ে ডিসেম্বরের র্যাংকিং প্রকাশ করেছে। কিন্তু সিমিলার ওয়েব যেখান থেকে ডাটা নেয় তথা গুগল অ্যানালাইটিকসের ডিসেম্বরের ডাটা ও মিডিয়া সার্ভের ডাটার মধ্যে কোনো মিল নেই। এমনকি সিমিলার ওয়েবের ডাটার সঙ্গেও মিডিয়া সার্ভের তথ্যে বেশ ফাঁরাক রয়েছে।
মিডিয়া সার্ভের র্যাংকিংয়ে যেসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামনের দিকে দেখানো হয়েছে সিমিলার ওয়েবের র্যাংকিংয়ে তারা অনেক পেছনে। আবার মিডিয়া সার্ভে কিছু কিছু ওয়েবসাইটকে র্যাংকিংয়ে পেছনের সারিতে ফেলেছে, সিমিলার ওয়েবের র্যাংকিংয়ে ওই সব প্রতিষ্ঠান প্রথম ৫টিতে রয়েছে। এতে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, মিডিয়া সার্ভে তাদের তথ্যের সোর্স হিসেবে সিমিলার ওয়েবকে উল্লেখ করলেও বিষয়টি সঠিক নয়। মিডিয়া সার্ভের করা জরিপ ভুয়া, মনগড়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিডিয়া সার্ভে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা দেওয়া হয়েছে নিউইয়র্ক। জানা গেছে, তাদের ঠিকানাটি ভুয়া। মূলত ঢাকায় বসে এটি পরিচালনা করা হচ্ছে। ঢাকার একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট তার কিছু ঘনিষ্টজনদের নিয়ে এটি পরিচালনা করছেন। তাদের মূল উদ্দেশ্য- ওই সাংবাদিকের প্রতিষ্ঠানকে র্যাংকিংয়ে সামনের দিকে দেখানো এবং আগ্রহী অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে র্যাংকিংয়ে এগিয়ে দেওয়ার কথা বলে মোটা অংকের টাকা নেওয়া।
মিডিয়া সার্ভের জরিপ যে ভিত্তিহীন সেটি বেরিয়ে এসেছে এএফপির বাংলাদেশ ফ্যাক্ট চেক এডিটর কাদরুদ্দিন শিশিরের একটি পোস্টে। শনিবার তিনি নিজের ফেসবুক পেজে লিখেছেন, “mediasurvey.org ওয়েবসাইটটির মজার দিক হলো- এটি একটি ‘ভুয়া ওয়েবসাইট’ এর প্রায় সব ক্রাইটেরিয়াই ফুলফিল করে!
ওয়েবসাইটে about-us নামে একটি ট্যাব আছে, যেখানে তাদের কোনো পরিচয় নেই। আছে লাতিন ভাষায় কিছু টেক্সট যার সঙ্গে মিডিয়া/সার্ভে ইত্যাদি বিষয়ের কোনো সংযোগ নেই। এই টেক্সট গুগলে সার্চ করলে বহু ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়; যা থেকে ধারণা যায় ওয়েবসাইট ডিজাইনাররা টেক্সটি কোনো ওয়েবসাইট তৈরির সময় ‘স্যাম্পল টেক্সট’ হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।
মিডিয়া সার্ভের ওয়েবসাইটে ‘Our Team’ বলে যাদের নাম ও ছবি দেওয়া আছে সেগুলোও বিভিন্ন ওয়েবসাইট ডিজাইনাররা ‘স্যাম্পল’ হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। ছবিগুলো মডেলদের। ভিয়েতনামিজ এ ওয়েবসাইটটিতেও তাদের ‘অ্যাবাউট আস’-এ একই মডেলদের নাম ও ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।
mediasurvey.org-এর Contact ট্যাবটিতেও ভুয়া তথ্য দেওয়া। মূলত এখানেও ওয়েবসাইট পরিচালনাকারীদের প্রকৃত নাম/ঠিকানা/যোগাযোগের উপায় না দিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘Email Address: info@example.comexample@yourmail.com; Location: 4462 Settlers Lane, New York, NY 10007; Phone: 123-456-7890+981 547 82 12’- যা মূলত আরেকটি ‘স্যাম্পল টেক্সট”।
শিশির আরও লেখেন, “যে ওয়েবসাইটের স্লোগান হচ্ছে ‘All Media Survey in Single Platform’ এবং যারা একটি দেশের সংবাদমাধ্যমের নানান দিক নিয়ে ‘জরিপ’ এবং ‘অ্যানালাইসিস’ প্রকাশ করতে চান তাদের ওয়েবসাইটের পরিচালনার সঙ্গে জড়িতদের নাম-পরিচয়, যোগাযোগ, উদ্দেশ্য, অর্থায়ন এবং তাদের কার্যক্রম সংক্রান্ত অন্য যাবতীয় তথ্য যার মধ্যে কাজের পদ্ধতিও (মেথডোলজি) রয়েছে— এসব প্রকাশের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা না থাকলে সেই ওয়েবসাইটকে ‘ভুয়া ওয়েবসাইট’ হিসেবে গণ্য করাই শ্রেয়।
ওয়েবসাইটে এটির পরিচালনার সঙ্গে জড়িত কারো কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন ইন্টারেকশন থেকে পাওয়া তথ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, ওয়েবসাইটটি পরিচালনা করেন যিনি, তিনি একটি টিভি চ্যানেলের ব্রডকাস্ট ও আইটি বিভাগের প্রধান। তাদের ফেসবুক পেজের ট্রান্সপারেন্সিও বলছে, পেজটির একমাত্র অ্যাডমিন বাংলাদেশে অবস্থান করেন।
মিডিয়া সার্ভের জরিপ নিয়ে প্রশ্ন তুলে অনলাইন সংবাদকর্মীদের একটি ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করেছেন এনটিভি অনলাইনের এডিটর ফখরুদ্দিন জুয়েল। তিনি জরিপকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে জানিয়ে লিখেছেন, ‘আপনি এক ইউনিক ভিজিটর দিয়ে ওয়েবসাইট র্যাংকিং করে ফেলছেন। অন্যান্য দেশে কি এগুলো চলে? বিবিসি অ্যালেক্সা বা সিমিলার ওয়েবে কত নম্বরে ছিল? সিএনএন? টাইমস অব ইন্ডিয়া, আল জাজিরা? মিডিয়া র্যাংকিং এতো সহজ? নিউইয়র্ক টাইমস? আমি অবশ্যই মনে করি সেসব দেশে আপনাদের মতো জ্ঞানী লোকের অভাব আছে।’
জাগো নিউজের এডিটর কেএম জিয়াউল হক বলেন, আগে অ্যালেক্সা ওয়েবসাইটগুলোর র্যাংক করত, যদিও সেটি নিয়ে কনট্রুভার্সি ছিল। বর্তমানে ওয়েবসাইটের স্ট্যান্ডার্ড র্যাংকিং করার মতো গ্রহণযোগ্য কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এখন মূলত গুগল অ্যানালাইটিকসের ডাটা নিয়ে ওয়েবসাইটের ভিজিটর নিরূপণ করা হয়।
ঢাকা পোস্টের সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকার বলেন, মিডিয়া সার্ভের প্রকাশিত র্যাংকিং ভিত্তিহীন। তাদের র্যাংক করার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার হাজারও সুযোগ রয়েছে। এসব র্যাংক প্রকাশ করে নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সবার সোচ্চার হওয়া উচিত।