Logo
Logo
×

জাতীয়

ওসি প্রদীপের নিষ্ঠুরতা

৩০ লাখ টাকা চাঁদা না দেয়ায় মাদক ব্যবসায়ী সাজিয়ে ক্রসফায়ার!

Icon

শফিউল্লাহ শফি, কক্সবাজার

প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২০, ০৭:৪৪ পিএম

৩০ লাখ টাকা চাঁদা না দেয়ায় মাদক ব্যবসায়ী সাজিয়ে ক্রসফায়ার!

লালবৃত্ত চিহ্নিত প্রদীপ কুমার (বাঁয়ে)। কালো গেঞ্জি পরিহিত ৮ মাস পূর্বের জলিলের ছবি (মাঝে)। গুলিবিদ্ধ কথিত বন্দুকযুদ্ধের পর জলিল (ডানে)। ফাইল ছবি

টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ দাশের নির্যাতন, ক্রসফায়ার, মামলা বাণিজ্য, হুমকিসহ আমানবিক ও লোমহর্ষক ঘটনার প্রকাশ পাচ্ছে প্রতিনিয়তই। একেক মানুষের ওপর চালানো অত্যাচারের বর্ণনা শুনলে গা শিউরে ওঠে। 

জনশ্রুতি রয়েছে, কে কতদিন প্রদীপের টর্চার সেলে আটকে ছিল তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানতেন না। 

এমন ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা হল টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড পশ্চিম মহেশখালীয়া পাড়ার মৃত আলী আহাম্মদের পুত্র সিএনজি চালক আব্দুল জলিলের প্রকাশ (গুরা পুতুইক্কা)। 

সূত্রমতে, সিএনজি চালক জলিলের রয়েছে দুই শিশু সন্তান ও স্ত্রীসহ ভাইবোন আত্মীয়-স্বজন। গাড়ি চালিয়ে যে কোনো মতেই সংসার চালাত জলিল। কিন্তু বেশি দিন তার কপালে সয়নি সন্তান, স্ত্রী ও ভাই, বোনসহ আত্মীয়স্বজনের ভালবাসা। 

একদিন প্রদীপ নামের ‘আজরাইলের’ শনি ভর করে তার ওপর। শেষ রক্ষাও হয়নি জলিলের। ধরেছিল তরতাজা ক্লিন সেভ করা টগবগে ৩৪ বছরের যুবক জলিলকে। আর যখন বন্দুকযুদ্ধের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় তখন জলিলকে চেনার কোন উপাই নেই। দাড়ি আর চুল ও ক্ষুধার যন্ত্রনায় এমন নির্মম পরিস্থিতি জলিলের শরীরের উপর দিয়ে গেছে ৯০ বছরের বৃদ্ধকে হার মানাবে। পাশাপাশি গুলি না করে সামান্য আঘাতেই মরে যেত জলিল। কিন্তু প্রদীপ তাতে বিশ্বাসী নয়।

প্রদীপের চাহিদা পূরণ করতে না পারায় সরকারি বুলেটের অপচয় করে কথিত বন্দুকযুদ্ধেও নামে চারটি গুলি জলিলের বুক ঝাঝরা করে দেয়। এমন লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিলেন সিএনজি চালক আবদুল জলিলের স্ত্রী ছেনুয়ারা বেগম (২৬)। 

ছেনুয়ারা বেগম যুগান্তরকে জানান, গত বছরের ২ ডিসেম্বর সিএনজি চালক স্বামী বিদেশ যাওয়ার উদ্দেশ্যে মেডিকেল দেয়ার জন্য চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। পরদিন ৩ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় কক্সবাজার পৌঁছে ব্যক্তিগত কাজে কক্সবাজারের আদালত পাড়ার মসজিদ মার্কেটে যায়। ওই সময় ডিবি পুলিশের এক ইন্সপেক্টরের নেতৃত্বে সাদা পোশাকদারী কয়েকজন স্বামী জলিলকে আটক করে নিয়ে যায়। 

পরে এই খবর শুনার পর স্বামীর সন্ধান পাওয়ার জন্য কক্সবাজার-টেকনাফের সংশ্লিষ্ট আইন-শৃংখলা বাহিনীর বিভিন্ন দফতরের দরজায় কড়া নাড়েন তিনি। কিন্তু কোথাও স্বামীর খোঁজ মেলেনি। খেয়ে না খেয়ে স্বামীর খোঁজে পার করে কয়েক মাস। পরে কক্সবাজারের স্থানীয় সংবাদিকদের মাধ্যমে "আমার স্বামী দুই মাস ধরে নিখোঁজ" শিরোনামে পত্রিকায় সংবাদ প্রচার করে। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। 

কিন্তু একদিন প্রদীপের টর্চার সেল থেকে জেলহাজতে যান হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ইউপি সদস্য জাহেদ। আর জাহেদ থেকে খবর পায় জলিল টেকনাফ থানায় ওসি প্রদীপের টর্চার সেলে রয়েছে। তাকে ডিবি ধরার পর হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির আইসি মশিউরের মাধ্যমে টেকনাফ থানায় হস্থান্তর করা হয়। 

তারপর থেকে বেশ কয়েকবার স্বামীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে ছেনুয়ারা। অঝরে কান্নাকাটি করে পৌঁছায় ওসি প্রদীপের দরজায়। কিন্তু প্রদীপের দাবি বিশাল। ৩০ লাখ টাকা দিতে হবে। না হয় স্বামী ক্রসফায়াওে যাবে। পরে হাতে পায়ে ধরে বিদেশ যাওয়ার জন্য জমিয়ে রাখা ৫ লাখ টাকা দেন ছেনুয়ারা। তাতে কোন কাজ হয়নি। শত চেষ্টায় দেখাও করতে পারেনি স্বামীর সঙ্গে। তবে জীবনের শেষ পর্যায়ে দেখা হয় স্বামী জলিলের সঙ্গে। কিন্তু কথা হয়নি। কারণ তখন স্বামী জলিলের রক্তাক্ত শরীর নিয়ে নিতর দেহে পড়ে ছিল হাসপাতালের মর্গে। 

নিহত জলিলের বড় ভাই আব্দুর রশিদ যুগান্তরকে বলেন, দীর্ঘ পাঁচ মাস আগে তার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য থানায় যাই। তবে দেখা করতে পারেনি। ওসি প্রদীপ নিজেই তাকে বলেছে তোমার ভাই বড় মাদক ব্যবসায়ী। তাকে যদি বাঁচাতে চাও ৩০ লাখ টাকা নিয়ে আসো। তখন ওসি প্রদীপকে আমি (রশিদ) বলি এত টাকা আমরা কোথায় পাবো স্যার। আমরা গরিব মানুষ, আমার ভাই কোনদিন মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল না। সে সিএনজি চালিয়ে সংসার চালায়। এভাবে থানার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায় দীর্ঘ আট মাস। কিন্তু ভাইকে দেখার সুযোগ দেয়নি প্রদীপ। 

একপর্যায়ে গত মাসের ৭ জুলাই গভীর রাতে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হোয়াইক্যং খারাংখালী সীমান্তে আমার বাড়ির পাশে ভাই নিহত হয়েছে। পরে খবর পেয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেখি আমার ভাই জলিলকে চেনার কোন উপায় নেই। ৩৪ বছরের যুবক জলিল দাড়ি, গোঁফ, চুল ও শরীরের অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল ৯০ বছরের বৃদ্ধ।
 
আবদুর রশিদ আরো বলেন, ওই সময় মহান আল্লাহর কাছে ওসি প্রদীপের বিচার চেয়েছিলাম। সর্বশেষ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার ঘটনার মধ্য দিয়ে আল্লাহ দেখাচ্ছে। 

এ বিষয়ে উখিয়া-টেকনাফের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আদিবুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, গত জুলাই মাসের শুরুতে আমি অতিরিক্ত দায়িত্বভার গ্রহণ করি দুই থানার। তবে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার সময় আমি করোনায় আক্রান্ত ছিলাম। যে কারনে এই বিষয় সর্ম্পকে আমি অবগত নই। 

প্রসঙ্গত, ওসি প্রদীপ বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার ঘটনায় তার বোনের মামলায় প্রদীপসহ ৭ পুলিশ সদস্য কক্সবাজার কারাগারে রয়েছে।
 

Jamuna Electronics

Document
Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম