ব্লাকমেইলিং ও অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগে গ্রেফতার রাজধানীর অপরাধ জগতের মাফিয়া শামিমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউয়ের অবাধ যাতায়াত ছিল রাজধানীন অভিজাত হোটেলগুলোতে। ওয়েস্টিন হোটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইট বরাদ্দ ছিল পাপিয়ার জন্য। সেখানে ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা থেকে শুরু করে প্রভাবশালীদের সঙ্গে সময় কাটাতেন পাপিয়া।
হোটেল ওয়েস্টিনে অবস্থানকালে কারা কারা পাপিয়ার কাছে যেতেন, তাদের নাম হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে চেয়েছে আইনশৃংখলা বাহিনী।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, হোটেলে অবস্থানের সময় পাপিয়া কার কার সঙ্গে দেখা করেছেন বা তার কাছে কারা কারা আসতেন, সে ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সিসি ফুটেজসহ প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে। একইসঙ্গে এই হোটেলে তিনি কীভাবে বিল দিতেন, তার ক্যাশ মেমোও চাওয়া হয়েছে।
৫ তারা ওয়েস্টিন হোটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল সুইট, যার প্রতিরাতের ভাড়া ২ হাজার ডলারের মতো, ভাড়া করে পাপিয়া যৌনবাণিজ্য চালাতেন বলে র্যাবের ভাষ্য।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি পাপিয়াকে গ্রেফতারের পর র্যাব-১ এর অধিনায়ক শাফী উল্লাহ বুলবুল বলেছিলেন, তার নামে ওই হোটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইট সব সময় বরাদ্দ থাকত।
হোটেলে নিয়মিত কয়েকজন তরুণী থাকত, যারা তার ‘কাস্টমারদের’ বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করত। এজন্য তাদের মাসিক বেতন বরাদ্দ ছিল।
পাপিয়া গ্রেফতার হওয়ার পর ওয়েস্টিনের মার্কেটিং কমিউনিকেশন বিভাগের সহকারী পরিচালক সাদমান সালাহউদ্দিন জানান, উনি (পাপিয়া) আমাদের স্যুইট নিয়েছিলেন।
এটা বিশাল আকারের তো, উনার গেস্টরা সেখানে ছিলেন। তিনি কাদেরকে নিয়ে সেখানে অবস্থান করেছেন কিংবা কতজন ছিলেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাবলিকলি প্রকাশ করা হোটেলের নিয়ম পরিপন্থী।
গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলের প্রেসিডেন্ট স্যুট নিজের নামে কয়েক মাস ধরে বুক করে অবৈধ নারী, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা এবং চাঁদাবাজিসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছিলেন শামীমা নূর পাপিয়া। র্যা ব বলছে, গত তিন মাসে শুধু ওই হোটেলেই পাপিয়া বিল দিয়েছেন এক কোটি ৩০ লাখ টাকা। হোটেলটির বারে তিনি প্রতিদিন বিল দিতেন প্রায় আড়াই লাখ টাকা। এই হোটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল সুইট বরাদ্দ ছিল পাপিয়ার।
ওয়েস্টিন হোটেলের ২২ তলায় সবচেয়ে বিলাসবহুল প্রেসিডেন্সিয়াল সুইটটিতে থাকতে বহু টাকা গুনতে হতো পাপিয়াকে। চার বেডরুমের ওই সুইটের প্রতিরাতের ভাড়া সাধারণভাবে দুই হাজার ডলারের মতো।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাপিয়া তার অতিথিদের প্রথমে নিয়ে যেতেন ওয়েস্টিনের লবিতে। পরে লাঞ্চ বা ডিনার শেষে সেখান থেকে নিয়ে যেতেন তার নামে বরাদ্দকৃত বিলাসবহুল প্রেসিডেন্সিয়াল সুইটে।
২৩ তলাবিশিষ্ট ঢাকা ওয়েস্টিন হোটেলের লেভেল-২২ এ ১ হাজার ৪১১ বর্গফুট জায়গাজুড়ে বিলাসবহুল প্রেসিডেন্সিয়াল সুইট। সেখানে অতিথিদের সুন্দরী তরুণীদের সঙ্গে কিছুক্ষণ বৈঠক করতেন পাপিয়া।
এর পর পছন্দসই তরুণীকে নিয়ে গোপন কক্ষে প্রবেশ করতেন ভিআইপিরা।
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে প্রথম অনলাইনভিত্তিক যৌন ব্যবসার প্ল্যাটফর্ম ‘এসকর্ট’ গড়ে তোলেন যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ। এটি গড়ে তুলতে রাজনীতিকে তিনি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন।
এখান থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সুন্দরী তরুণী সরবরাহ করা হতো। কয়েক বছর আগে ‘এসকর্ট’টি গড়ে তোলা হলেও এরই মধ্যে তা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সারাদেশের বিভাগীয় শহরগুলোয়।
যৌনব্যবসার অনলাইনভিত্তিক সাইট ‘এসকর্ট’ এখনও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় রয়েছে। রিমান্ডের প্রথম দিনেই জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য দিয়েছেন সদ্য বহিষ্কৃত যুব মহিলা লীগ নেত্রী পাপিয়া। এসকর্টের সঙ্গে জড়িত দেহব্যবসায়ী সুন্দরী তরুণী এবং তাদের খদ্দেরদের নামও বলেছে পাপিয়া।
র্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, রাজনীতির নারীদের নিয়ে ‘বাণিজ্য’ করতেন পাপিয়া। রাজধানীর অভিজাত হোটেলগুলোয় মাঝেমধ্যেই ‘ককটেল পার্টি’র আয়োজন করতেন। এসব পার্টিতে উপস্থিত হতেন সমাজের উচ্চস্তরের লোকজন। মদের পাশাপাশি পার্টিতে উপস্থিত থাকত এসকর্ট গ্রুপের উঠতি বয়সী সুন্দরী তরুণীরা।
মদের নেশায় টালমাটাল আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে কৌশলে ধারণ করা হতো ওই তরুণীদের অশ্লীল ভিডিও। পরে ওইসব ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন সময়ে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করতেন পাপিয়া। বনিবনা না হলেই ফেসবুকে ছড়িয়েও দেয়া হতো।
পাপিয়ার যত অনৈতিক কর্মকাণ্ড
র্যাব জানায়, যুবলীগ নেত্রী পাপিয়া পিউ নামেই বেশি পরিচিত। এই নেত্রীর প্রকাশ্য আয়ের উৎস গাড়ি বিক্রি ও সার্ভিসিংয়ের ব্যবসা। এর আড়ালে জাল মুদ্রা সরবরাহ, বিদেশে অর্থপাচার এবং অবৈধ অস্ত্র রাখাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এসব অভিযোগের অনুসন্ধান করছিল র্যা বের একটি দল। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে শনিবার সকালে তড়িঘড়ি করে দেশত্যাগের চেষ্টা করেন পাপিয়া। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। সহযোগীসহ গ্রেফতার হন তিনি।
র্যাব কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফীউল্লাহ বুলবুল বলেন, গাড়ির ব্যবসার আড়ালে তিনি অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। সমাজসেবার নামে তিনি নরসিংদীর অসহায় নারীদের অনৈতিক কাজে লিপ্ত করে আসছিলেন। তিনি গুলশানের একটি অভিজাত হোটেলের প্রেসিডেন্ট স্যুট নিজের নামে বুক করে নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে আসছিলেন।
র্যাব জানায়, পাপিয়ার স্বামীর থাইল্যান্ডে বারের ব্যবসা রয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ অস্ত্র-মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা বিচারাধীন। তিনি স্ত্রীর মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসহায় নারীদের অনৈতিক কাজে ব্যবহার করেন।