নৌ শ্রমিকদের ধর্মঘটে অচল রাজধানীর সদরঘাট। ছবি: যুগান্তর
গেজেট অনুসারে বেতনভাতাসহ ১১ দফা দাবিতে সারা দেশে ধর্মঘট পালন করছে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন নেতারা। ফলে শুক্রবার মধ্যরাত থেকে সারা দেশে লঞ্চ ও পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এতে শনিবার দিনভর ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রী ও ব্যবসায়ীরা।
বিশেষত বরিশাল ও খুলনা বিভাগের মানুষ বেশি দুর্ভোগে পড়েন। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর ও ১৬টি ঘাটে পণ্য খালাস বন্ধ ছিল। দেশি-বিদেশি জাহাজগুলোয় ৩০ লাখ টনের বেশি পণ্য আটকা পড়ে। মোংলা বন্দর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ, খুলনা ও যশোরের অভয়নগরসহ বেশির ভাগ বন্দরে জাহাজ থেকে পণ্য লোড-আনলোড কার্যক্রম কার্যত বন্ধ ছিল। তবে ঢাকা নদীবন্দর (সদরঘাট) থেকে হাতেগোনা কয়েকটি লঞ্চ ছেড়ে গেছে।
এ ধর্মঘটকে অবৈধ আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাহরসহ ৬ দফা দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে পণ্যবাহী জাহাজ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন।
সংগঠনের নেতারা বলেন, নৌ খাতকে ধ্বংস করতে ৫-৬টি শ্রমিক সংগঠন যখনতখন ধর্মঘট ডাকছে। এ অবস্থার পরিত্রাণ চাই। অপরদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনে মালিক ও শ্রমিক নেতাদের নিয়ে আলাদা বৈঠকে বসে শ্রম অধিদফতর। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বৈঠকে কোনো সুরাহা হয়নি।
এর আগে বুধবার আগাম ঘোষণা ছাড়া নৌযানে কর্মবিরতি পালন করে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক অধিকার সংরক্ষণ ঐক্য পরিষদ নামের একটি সংগঠন। এদিন সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ঢাকা নদীবন্দর থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ ছিল। ওই সময়ও দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ যাত্রী ও ব্যবসায়ীরা। পরে সরকার দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলে তা প্রত্যাহার করা হয়। এর দুই দিন পর শনিবার ফের ধর্মঘট শুরু করল শ্রমিক ফেডারেশন।
ধর্মঘটে ভোগান্তির বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন অধিফতরের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমডোর এম মাহবুব উল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করায় অনেক নৌযান চলাচল করেনি। এতে যাত্রীদের যেমন ভোগান্তি হয়েছে, তেমনি পণ্য পরিবহনে সংকট তৈরি হচ্ছে। গত বুধবার শ্রম অধিদফতরে তিন দফায় মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠকে অনেক দাবি মেনে নেয়া হয়েছে। আমি আশা করি, মানুষের ভোগান্তি অনুধাবন করে এ ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হবে।
দেখা গেছে, শনিবার সকাল থেকে সদরঘাট অনেকটাই ফাঁকা। যাত্রী উপস্থিতিও কম। পুলিশ ও মালিকদের উপস্থিতিতে চাঁদপুরের উদ্দেশে কয়েকটি লঞ্চ ছেড়ে গেছে। ধর্মঘটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সদরঘাট টার্মিনালে মিছিল করেন ঘাট শ্রমিকরা। গাজীপুরের মাওনা থেকে সস্ত্রীক সদরঘাট টার্মিনালে আসেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী মো. সোহাগ।
তিনি বলেন, পাঁচদিনের ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়ি বরিশাল যাব। কিন্তু সদরঘাট আসার পর ধর্মঘটের কথা শুনলাম। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, লঞ্চ ছাড়বে না জানলে তিন ঘণ্টা জার্নি করে সদরঘাট আসতাম না। এখন আবার তিন ঘণ্টা জার্নি করে ফেরত যেতে হবে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাসে যাওয়া আরেক দুর্ভোগের বিষয়।
ধর্মঘটের কারণে বেশির ভাগ চালক লঞ্চ থেকে নেমে গেছেন জানিয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক মো. আলমগীর কবীর যুগান্তরকে বলেন, বেশির ভাগ লঞ্চের মাস্টারদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে মালিকরা ওইসব লঞ্চ ছাড়তে পারছেন না। সদরঘাটে যাত্রীদের আনাগোনাও কম। বরিশালের লঞ্চ বন্ধ রয়েছে।
দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার কথা জানান বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মো. শাহ আলম। তিনি বলেন, শ্রম অধিদফতরের ডাকে আমরা বৈঠকে এসেছি। মালিকপক্ষ শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করে চলে গেছেন। আমাদের সঙ্গে তারা বসবেন না বলে জানিয়েছেন। তারা যদি আমাদের সঙ্গে না বসেন, তবে আলোচনা ফলপ্রসূ হবে কি? তিনি বলেন, আমাদের দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক অনেক চুক্তি করেও তারা মানেননি। তাই ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে।
এর আগে শনিবার দুপুরে শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা এক যুক্ত বিবৃত্তিতে জানান, ১১ দফা দাবি নিয়ে প্রায় ১৬ মাস আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন নৌযান শ্রমিকরা। মালিক সমিতির অধিকাংশ সংগঠন সরকারের আহ্বানে বৈঠকে উপস্থিত না হওয়া ও চুক্তি বাস্তবায়ন না করায় বাধ্য হয়ে দাবি বাস্তবায়নের জন্য কর্মবিরতি পালন করছে। নেতারা আশা করেন, সরকার ও প্রশাসন ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে মালিকপক্ষকে ডেকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। অন্যথায় উদ্ভ‚ত পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের ওপর জুলম-নির্যাতনের ফলে পরিস্থিতির আরও অবনিত হলে এর দায় সরকারকেই নিতে হবে।
এ ধর্মঘট অবৈধ: কার্গো মালিক
নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘট অবৈধ আখ্যায়িত করে ছয় দফা দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। শনিবার দুপুরে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান সংগঠনের নেতারা।
অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুল হক বলেন, নৌ খাতকে ধ্বংস করার জন্য ৫-৬টি শ্রমিক সংগঠন বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে যত্রতত্র ধর্মঘট পালন করে দেশ অচল করে দিচ্ছে। এ সংগঠনগুলোর দেশের প্রধান নদীবন্দরে শাখা অফিস আছে এবং এসব অফিসে চাকরিচ্যুত অথবা বয়স উত্তীর্ণ শ্রমিকরা ২০-৩০ বছর ধরে বিভিন্ন পদ দখল করে আছে। এ অফিসগুলো মূলত নৌযানকে জিম্মি করে মালিকদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করে আর্থিক সুবিধা আদায় করে। সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফা দাবি তুলে ধরা হয়।
দাবিগুলো হচ্ছে- অবৈধ ধর্মঘট বন্ধ করা। শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে কোনটি সিবিএ, তা নির্ধারণ করা। বেতন স্কেলবহিভর্‚ত মনগড়া বেতনভাতা আদায়ের নামে নৌযান আটক বন্ধ করা। চট্টগ্রামে নৌপথে বাল্কহেডের অবৈধ চলাচল বন্ধ করা। মাদার ভেসেল থেকে সিরিয়াল অনুযায়ী পণ্য বহন এবং নৌপথে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্য ঠিক রাখা।
নুরুল হক বলেন, নৌপথের সমস্যা ও নৈরাজ্য বন্ধ না হলে মালিকদের পক্ষে জাহাজ পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। নিরুপায় হয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিতে হবে।