হাবিবুর রহমান মিজান। ফাইল ছবি
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান গ্রেফতার হয়েছেন। গ্রেফতারের আগে তিনি মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল সীমান্ত দিয়ে ভারত পালানোর চেষ্টা করছিলেন।
মোহাম্মদপুর এলাকায় জমিদখল, টেন্ডারবাজি, প্রভাব বিস্তারসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে পাগলা মিজানের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগে একাধিক মামলাও রয়েছে। তিনি মোহাম্মদপুরের বাসিন্দাদের কাছে ত্রাস হিসেবে পরিচিত। তার ভয়ে তটস্ত থাকেন সেখানকার বাসিন্দারা।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাগলা মিজান আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী। তিনি দল পাল্টে রাতারাতি বনে যান ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতায়। পরে নেতাদের আশীর্বাদে মোহাম্মদপুরে গড়ে তুলেন অপরাধ সাম্রাজ্য। মাদক কারবার থেকে শুরু করে খুন-খারাবি পর্যন্ত নানা অপরাধমূলক কাণ্ডে তার নাম উঠে এসেছে বারবার।
মহাজোট সরকারের আমলে মিজান বাহিনী ৩০০-৪০০ কোটি টাকার শুধু টেন্ডারবাজিই করেছে। এ ছাড়া ভূমিদখল, চাঁদাবাজিসহ মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পে মাদক ও চোরাই গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ মিজানের হাতে। স্থানীয় লোকজন বলেন, খুন-খারাবি পাগলা মিজানের বাঁ হাতের কাজ। এ কারণে এলাকায় কেউ তার ভয়ে কথা বলেন না।
মোহাম্মদপুর এলাকার স্থানীয় সূত্র জানায়, ষাটের দশকে ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় আসেন মিজান। এক সময় তিনি ফ্রিডম পার্টির রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮৯ সালে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার অন্যতম পরিকল্পনাকারী তিনি। ওই মামলার চার্জশিটে তাকে অভিযুক্ত করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯১ সালে নিজের নাম পরিবর্তন করে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। নাম পাল্টে মিজানুর রহমান হন হাবিবুর রহমান মিজান। ১৯৯৪ সালে তিনি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগে বড় পদ পান। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। বাড়ি দখল, জমি দখল, খুন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ অনেক অপরাধে যুক্ত হন । তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেতেন না। ১৯৯৬ সালে ইউনুস হত্যা ও ২০১৬ সালে সাভার থানায় জোড়া খুনের মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পে মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তিনি একাধিকবার গ্রেফতার হন। শ্যামলী মাঠের পশ্চিম পাশের জমির একাংশ দখল করে বানিয়েছেন মার্কেট। সেখানে তিন শতাধিক ঘর তুলে ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দিয়েছেন তিনি।
জানা গেছে, ওয়ার্ড কাউন্সিলর পাগলা মিজানের মাসিক সম্মানী মাত্র ৩৫ হাজার টাকা। এর সঙ্গে ভাতা যোগ হয় ১২ হাজার টাকা। এছাড়া তার বৈধ আয়ের অন্য কোনো উৎস নেই।
অথচ যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে তার বিলাসবহুল বাড়ি আছে। ঢাকাতেও আছে তার দুটি আলিশান বাড়ি এবং একটি ফ্ল্যাট। ১৫ বছর আগে তার ব্রিকফিল্ডের ব্যবসা ছিল। সবই হয়েছে অবৈধ আয়ের টাকায়। জীবনের শুরুতে মিজান ছিলেন হোটেল বয়। পরে ম্যানহোলের ঢাকনা চুরির মাধ্যমে তিনি অপরাধে জড়ান। ধীরে ধীরে চুরি, ছিনতাই, খুন-জখম, দখলদারিত্বসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।
অবৈধ আয়ের অর্থেই তিনি টেক্সাসের বাড়ি কিনেছেন। ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় পাঁচ ও ছয়তলার দুটি বাড়ি এবং একটি ফ্ল্যাট কেনেন। এছাড়া দেশে-বিদেশে নিজের ও আত্মীয়স্বজনের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ করেছেন। শুক্রবার মিজানকে গ্রেফতারের পর তার ঢাকার বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এক কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) কাগজপত্র এবং ছয় কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক। গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পেয়েছে র্যাব।
এদিকে মিজানের বাসা থেকে এফডিআর ও চেক উদ্ধারের ঘটনায় শনিবার তার বিরুদ্ধে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করে র্যাব। এই মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতের মাধ্যমে ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে। শনিবার বিকালে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিভানা খায়ের জেসি রিমান্ডের এ আদেশ দেন।
এর আগে শুক্রবার ভোরে শ্রীমঙ্গলের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মিজানকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ সময় একটি অবৈধ পিস্তল, চার রাউন্ড গুলি ও নগদ দুই লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। তিনি সীমান্ত এলাকা হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এ ঘটনায় শনিবার শ্রীমঙ্গলে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে একটি মামলা করেছে র্যাব।