বিমান ছিনতাইকারী পলাশ ২০১২ সালে নারী অপহরণ করে: র্যাব
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৫:২৯ এএম
ছবি : সংগৃহীত
ঢাকা থেকে দুবাইগামী বিমান হামলার চেষ্টাকারী যুবক মো. পলাশ আহমদ র্যাবের তালিকাভূক্ত অপরাধী। তাকে ২০১২ সালে তরুণী অপহরণের অভিযোগ এবং ৮ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল।তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য জানিয়েছেন র্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান।
সোমবার বেলা ৩টায় র্যাব সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব তথ্য জানান।
মুফতি মাহমুদ বলেন, পলাশ আগেও বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। ২০১২ সালের মার্চে পলাশ আহমেদ ও তার এক সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়। তার অপরাধ ছিল, সে একজন নারীকে অপহরণ করে আট লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। র্যাবের ক্রিমিনাল ডেটাবেইজে এ তথ্য লেখা আছে।
র্যাবের অপরাধী তথ্যভান্ডারের বিবরণ দিয়ে মুফতি মাহমুদ আরও জানান, পলাশের জন্ম ১৯৯৪ সালে। ২০১২ সালে যখন পলাশকে গ্রেফতার করা হয় তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। ওই সময়ই সে নিজেকে বিবাহিত বলে দাবি করে।
র্যাবের ডাটাবেইজে সে সময় পলাশের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি সমমানের। সে মাদরাসা বোর্ডের শিক্ষার্থী ছিল।
মুফতি মাহমুদ আরও জানান, বিমান ছিনতাই চেষ্টার ওই ঘটনার পর র্যাব-৭ ঘটনাস্থলে যায়। রর্যাবের বোমা ডিস্পোজাল ইউনিট সেখানে কাজ করে।পলাশের শরীরে বিস্ফোরকসদৃশ যা পাওয়া গেছে তাতে কোনো বিস্ফোরক ছিল না।এটা ভুয়া একটা জিনিস ছিল, যেখানে ভুয়া তার-সার্কিট দিয়ে ভেস্টের মতো তৈরি করা হয়েছিল।
এর আগে সকালে এক মুঠোফোন বার্তায় র্যাবের পক্ষ থেকে পলাশের পরিচয় শনাক্ত হওয়ার বার্তা জানানো হয়।র্যাব জানায়, ছিনতাই চেষ্টাকারী ওই যুবকের নাম মো. পলাশ আহমেদ। তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে। সে বিমানের ঢাকা-চট্টগ্রাম অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রী ছিল।
ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে পলাশের পরিচয় জানা গেছে। র্যাবের দেয়া তথ্যানুয়ায়ী, পলাশের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার পিরোজপুরের দুধঘাটা গ্রামে। তার বাবার নাম পিয়ার জাহান সরদার। ওই উড়োজাহাজের ১৭/এ নম্বর আসনের যাত্রী ছিল পলাশ আহমেদ। সে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম রুটের যাত্রী ছিল।
র্যাব বলছে, রোববারের অভিযানে নিহত বিমান ছিনতাইচেষ্টাকারী যুবকের আঙুলের ছাপ র্যাব ক্রিমিনাল ডেটাবেজের (অপরাধী তথ্যভাণ্ডার) একজন অপরাধীর সঙ্গে মিলে গেছে। ডেটাবেজ অনুযায়ী, যুবকের নাম পলাশ আহমেদ। তার বাবার নাম পিয়ার জাহান সরদার।
ছিনতাইয়ের চেষ্টা করা বাংলাদেশ বিমানের ময়ূরপঙ্খি উড়োজাহাজের (বিজি-১৪৭ ফ্লাইট) যাত্রী তালিকায় তার নাম উল্লেখ ছিল AHMED/MD POLASH। সিট নম্বর ১৭এ। পলাশ আহমেদ ঢাকা-চট্টগ্রাম অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রী ছিল।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান গণমাধ্যমকে জানান, নিহত ওই যুবক ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বিমানে চড়েন চট্টগ্রামে যাওয়ার উদ্দেশে। চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাওয়ার কথা ছিল ওই বিমানটি।
ক্রিমিনাল ডাটাবেজ থেকে পলাশের পরিচয় শনাক্তের কথা বললেও ঠিক কী ধরনের অপরাধের জন্য তার নাম র্যাবের ক্রিমিনাল ডেটাবেজে যুক্ত করা হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো তথ্য দেননি এ মুফতি মাহমুদ।
এর আগে রোববার রাতে ওই যুবকের পরিচয় নিয়ে একাধিক তথ্য জানানো হয়, যা নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়। প্রথমে বলা হয় তার নাম মাহাদী। পরে বলা হয় মো. মাজিদুল। তবে টিকিটে তার নাম মো. মাজিদুল লেখা ছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানানো হয়। কিন্তু আজ যে তথ্য এলো তাদের দেখা যাচ্ছে তার নাম মাহাদী ও মাজিদুল কোনোটিই নয়; তার নাম পলাশ।
গুলিতে নিহত হওয়ার সময় যুবকের নাম মাহাদী বলে জানান চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মতিউর রহমান।
রোববার রাত পৌনে ৯টার দিকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় ওই যুবকের নাম মাজিদুল।
প্রসঙ্গত বাংলাদেশ বিমানের দুবাইগামী একটি উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের চেষ্টা পাইলট-ক্রুদের তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তা ও যৌথবাহিনীর অভিযানে ব্যর্থ হয়েছে। রোববার বিকালে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার পর মধ্যাকাশে এ ঘটনা ঘটে।
এর পর অত্যন্ত সুকৌশলে ককপিটের দরজা বন্ধ করে বিমানটিকে শাহ আমানত বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করেন পাইলট। সেখানে উদ্ধার অভিযানের সময় উড়োজাহাজে থাকা অস্ত্রধারী ছিনতাইকারীকে আহতাবস্থায় আটক করা হয়। পরে তার মৃত্যু ঘটে। এর আগে বিমানটির যাত্রী-ক্রুসহ সবাইকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়।
বিমানের একজন পরিচালক জানান, বিজি-১৪৭ নম্বর ফ্লাইটটি রোববার বিকাল সাড়ে ৪টায় ঢাকা থেকে ছেড়ে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাওয়ার সিডিউল ছিল। এতে ১৩৪ যাত্রী ও ১৪ ক্রুসহ ১৪৮ জন ছিলেন।
ফ্লাইটের ককপিটে ছিলেন ক্যাপ্টেন শফিউল ও ফার্স্ট অফিসার মুনতাসির। কেবিন ক্রু ছিলেন নিম্মি, হুসনে আরা, সাগর, সাকুর ও বিথী। ওই ফ্লাইটটি হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে টেকঅফ করার পর পরই ককপিটে বসে ক্যাপ্টেন শফিউল ও ফার্স্ট অফিসার মুনতাসির কোনোভাবে আঁচ করতে পারেন ভেতরে যাত্রীবেশে সন্ত্রাসী ঘাপটি মেরে আছে।
এর পরই পাইলট শাহ আমানতের টাওয়ারের কাছে জরুরি অবতরণের মেসেজ পাঠান। অত্যন্ত সুকৌশলে তিনি ফ্লাইটটি ল্যান্ড করার পর দ্রুত যাত্রীদের নিয়ে বের হয়ে আসতে সক্ষম হন।
একটি সূত্র জানায়, ওই ফ্লাইটটি টেকঅফের পর পরই নিহত ব্যক্তি যাত্রী ককপিটে গিয়ে পাইলটের সঙ্গে কথা বলতে চান। তাকে সে সুযোগ দেয়া হলে সে ক্যাপ্টেনকে জানায়- জরুরিভাবে এখনই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে হবে।
এর পরই ক্যাপ্টেন কৌশলে জরুরি অবতরণের মেসেজ পাঠান টাওয়ারে। বিকাল ৫টা ৪১ মিনিটে ফ্লাইটটি শাহ আমানতে অবতরণের সঙ্গে সঙ্গেই কেবিন ক্রুরা পেছনের জরুরি নির্গমনের দরজা দিয়ে একে একে সব যাত্রীকে বের করে আনেন। এদিকে ককপিটে আলোচনারছলে ক্যাপ্টেন ওই অস্ত্রধারীকে রেখেই বের হয়ে আসতে সক্ষম হন। ভেতরে তখন ছিলেন কেবিন ক্রু সাগর।
এদিকে খবর পেয়ে চট্টগ্রাম বিমানবাহিনী ঘাঁটির অধিনায়ক এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী, র্যাবসহ অন্যান্য নিরাপত্তারক্ষীদের যৌথ অভিযানের প্রস্তুতি নেয়া হয়। তারা গ্রাউন্ড থেকে ফোনে অস্ত্রধারীর সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। তাকে ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত রেখে হঠাৎ একপর্যায়ে ফ্লাইটের ভেতরে পৌঁছে যান নিরাপত্তারক্ষীরা। তারা ওই অস্ত্রধারীকে জাপটে ধরে বের করে আনেন।
পুলিশের বিশেষ শাখার ডিআইজি আকমল হোসেন বলেন, ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার পর অস্ত্রধারী ককপিটে ঢুকে পাইলটকে পিস্তল ধরে বলেন, আমাকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে হবে। পাইলট ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে চট্টগ্রামে অবতরণ করান।
ওই বিমানের যাত্রী সংসদ সদস্য মাঈনউদ্দিন খান বাদল গণমাধ্যমকে বলেন, পাইলট আমার সঙ্গে নেমে এসেছিলেন। তিনি বলেছেন- তাকে পারসু করার চেষ্টা করেছে হাইজ্যাকার, বলছে সে শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী ক্রু জানান, সাড়ে ৪টার কিছু সময় পর ময়ূরপপঙ্খি (বিজি-১৪৭) আকাশে প্রায় ১৫ হাজার ফুট ওপরের দিকে উড়ে যাচ্ছিল। তখন উড়োজাহাজের ভেতরে যাত্রীদের আসনে থাকা এক ব্যক্তি উঠে ককপিটের দিকে আসেন।
এ সময় ওই ব্যক্তি এক ক্রুর কাছে যান। কাছে গিয়ে তিনি ওই ক্রুকে ধাক্কা দেন এবং সঙ্গে সঙ্গে একটি পিস্তল ও বোমাসদৃশ একটি বস্তু বের করে বলেন, ‘আমি বিমানটি ছিনতাই করব। আমার কাছে পিস্তল ও বোমা আছে। ককপিট না খুললে আমি বিমান উড়িয়ে দেব।’
এর মধ্যে অন্য কেবিন ক্রুরা ককপিটে থাকা পাইলট ও সহকারী পাইলটকে গোপনে সাংকেতিক বার্তা দেন যে, উড়োজাহাজে অস্ত্রধারী আছে, উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের চেষ্টা হচ্ছে। ঠিক এ সময় উড়োজাহাজটি চট্টগ্রাম ও ঢাকার মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থান করছিল। তিনি বলেন, পাইলট মো. শফি ও সহকারী পাইলট মো. জাহাঙ্গীর কৌশলে সফলভাবে জরুরি অবতরণ করেন।
এ সময় চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে ছিলেন ওমানগামী ফ্লাইটের যাত্রী কাউছার। তিনি জানান, ছিনতাইয়ের কবলে থাকা বিমানটি যখন অবতরণ করে, তখন তারা দ্বিতীয়তলায় ছিলেন। পৌনে ৬টার দিকে বিমানটি জরুরি অবতরণ করে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানবন্দরের অফিস স্টাফদের বিমানটির কাছে ছুটে যেতে দেখেন।
তিনি আরও বলেন, প্রথম দিকে যখন হুড়োহুড়ি শুরু হয়, তখন আমিসহ অনেকেই নিচতলায় নেমে আসি। এ সময় ওই বিমানের কয়েকজন যাত্রী বিমানে গুলির ঘটনা ঘটেছে বলে জানান।
৮ মিনিটের সফল অভিযান : পুরো ঘটনা সম্পর্কে রাত পৌনে ৯টার দিকে ব্রিফিং করেন চট্টগ্রামের সেনা নিবাসের জিওসি মতিউর রহমান। তিনি বলেন, বিকাল ৫টা ৩৩ মিনিটে পাইলট ককপিট থেকে কন্ট্রোল টাওয়ারকে জানান, বিমানটি ছিনতাই হয়েছে। এর পর ৫টা ৪১ মিনিটে সেটি অবতরণ করে। অবতরণের পর বিমানবাহিনী দ্রুত ‘মুভ’ করে। অন্যান্য বাহিনী জরুরি অবস্থায় যেসব নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হয় সেসব ব্যবস্থা নেয়।
সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ডো ও বিমানবাহিনীর টিম দ্রুত বিমানবন্দরে অবস্থান নেয়। বিমানটি ঘিরে রাখে। অভিযানে নেতৃত্বদানকারী এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান প্রথমে মোবাইল ফোন থেকে ওই দুষ্কৃতকারীর সঙ্গে কথা বলেন।
তাকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। তখন ওই দুষ্কৃতকারী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এবং তার (দুষ্কৃতকারী) স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চান। জিওসি আরও বলেন, তার সঙ্গে আমরা অনবরত মোবাইল ফোনে কথা বলে তাকে ব্যস্ত রাখি।
যাতে কোনো ধরনের অঘটন ঘটাতে না পারে। যেহেতু আমরা দ্রুততম সময়ে অপারেশন শেষ করতে চেয়েছি, তাই দেরি না করে অভিযান শুরু করি। এতে গোলাগুলি হয়। আহতাবস্থায় ওই দুষ্কৃতকারীকে বিমান থেকে বের করে আনি।
পরে সে মারা যায়। তার কাছে একটি পিস্তল পাওয়া গেছে। ৮ মিনিটের মধ্যেই সফলভাবে কমান্ডো অভিযান সম্পন্ন হয়।