তসলিমা নাসরিনের শাস্তি মাথা পেতে নিলাম: মাসুদা ভাট্টি
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০১৮, ০৫:০৭ পিএম
তসলিমা নাসরিন ও মাসুদা ভাট্টি
এবার আলোচিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বক্তব্য নিয়ে খেদ প্রকাশ করে সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টি বলেছেন, তিনি একটি লেখার জন্য আমাকে ক’বার শাস্তি দেবেন? এরতো কোথাও না কোথাও একটা শেষ হতে হবে, নয়? হয়তো এবারই সেই চরম শাস্তিটুকু তিনি আমায় দিলেন। আমি মাথা পেতে নিলাম।
মাসুদা ভাট্টিকে ‘ভীষণ চরিত্রহীন’ আখ্যা দিয়ে তসলিমা নাসরিনের বক্তব্যের জবাবে রোববার দিবাগত রাতে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি এসব কথা বলেন।
এই নারী সাংবাদিক বলেন, তিনি এরকম একটি চরম সংকটকালে যখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কবলে থেকে একদল মানুষ ন্যায়ের জন্য লড়ছে, তখন মইনুল হোসেনের দেয়া তকমা ‘চরিত্রহীনের’ সঙ্গে একটি ‘ভীষণ’ বিশেষণ জুড়ে দিয়ে আমার চরিত্রের সার্টিফিকেটকে আরো শক্ত করেছেন।
‘তবে তিনি কখনোই আমাকে তার পাবলিশার হিসেবে চিঠি দেননি, দিয়েছিলেন তার একজন ‘ফ্যান’ বা সমর্থক হিসেবে বর্ণনা করে। খুঁজলে সে চিঠি আমি নিশ্চয়ই পাবো।’
‘আমি এ জন্য তার কাছে কৃতজ্ঞ। অগ্রজ লেখক হিসেবে হয়তো এটুকুই আমার প্র্রাপ্য তার কাছে,’ বলেন এ নারী সাংবাদিক।
তসলিমা নাসরিনকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত ক্ষোভকে প্রকাশ করে ২০ বছর আগে দেয়া একটি বক্তব্যের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তিনি একটি মোক্ষম সময় বেছে নিয়েছেন।
‘যে সব ঘটনার উল্লেখ তিনি করেছেন, তা ২০০০ সালের এবং তিনি সত্যিই আমাকে চিঠি দিয়েছিলেন। কারণ তখন আমাকে ব্রিটেন থেকে বের করে দেয়ার একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।’
মাসুদা ভাট্টি বলেন, একটি আলোচিত সাক্ষাতকার গ্রহণের পর থেকে আমার সে দেশে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়েছিল এবং তখনও অনেক সাংবাদিক আমার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, এখন যেমন দাঁড়িয়েছেন।
‘যখন তার প্রথম আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘ক’ বের হলো, তখন এই বই নিয়ে প্রচারণার অংশ হিসেবেই আমি একটি পুস্তক সমালোচনা লিখি।’
তখন নারীবাদ, নারীর প্রতি সহিংসতা, উদারনৈতিক ও সমতাভিত্তিক সমাজব্যাবস্থা সম্পর্কে খুব বেশি একাডেমিক লেখাপড়া ছিল না জানিয়ে মাসুদা ভাট্টি বলেন, আমি সমালোচনায় বইটি সম্পর্কে এই কথাই বলতে চেয়েছিলাম যে, একজন ব্যক্তির সঙ্গে আরেকজন ব্যক্তির স্বেচ্ছা-সম্পর্কের দায় দুপক্ষের সমান এবং তা প্রকাশের আগে অন্যপক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন পড়ে - ‘ক’ বইটি পাঠে আমার তা মনে হয়নি।
‘প্রায় কুড়ি বছর আগের লেখা এবং সেখানে আমি তসলিমা নাসরিনকে কোনোভাবেই ব্যক্তিগত কোনো আক্রমণ করিনি। করতে পারি না। কারণ আমি সবসময় একথাই বলে এসেছি যে, আজকে যে আমরা মেয়েরা অনায়াস-লেখা লিখতে পারছি তার মূলপথ আমাদের জন্য উন্মুক্ত করেছেন তসলিমা নাসরিন।’
তিনি বলেন, অথচ গত কুড়ি বছর যাবত তসলিমা নাসরিন অন্তত কুড়িবারেরও বেশি এই প্রসঙ্গে আমাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন তার প্রকাশিত বইতে, লেখায় এবং তার ও আমার জানাশোনা ব্যক্তিবর্গের কাছে।
২০০০ সালের পরে অসংখ্য লেখায় তসলিমা নাসরিনের প্রশংসা করেছেন জানিয়ে মাসুদা ভাট্টি বলেন, সে কারণে আমাকে সমালোচকরা ‘নতুন তসলিমা নাসরিন’ আখ্যা দিয়ে আমার বিচার, অপমান এবং ফাঁসিও চেয়েছে।
‘তসলিমা নাসরিন এসব কথা কখনও উল্লেখ করেননি, তিনি সব সময় গত কুড়ি বছর ধরে বহুবার, বহু জায়গায় আমার এই পুস্তক-সমালোচনার কথা উল্লেখ করে আমাকে চরম আঘাত করেছেন।’
সামাজিক মাধ্যমে মাসুদা ভাট্টিআরও বলেন, আমি বিরত থেকেছি জনসমক্ষে কিছু বলা থেকে। কিন্তু তসলিমা নাসরিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে আমি বহুবার একথা বলেছি যে, তার বইয়ের সমালোচনায় আমি যা বলেছি সেটা একেবারেই তার বইয়ে সন্নিবেশিত তথ্যের সমালোচনা, তার ব্যক্তি-সমালোচনা নয়।
‘আমি একথা ২০০৩ সালেই প্রকাশ্যেও লিখেছি, এমনকি যখন তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তখন আমি প্রতিবাদ করেছি, লেখকের বিরুদ্ধে মামলা বা বই নিষিদ্ধের দাবির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছি,’ বলেন এ লেখিকা।
‘আমার সেসব প্রতিবাদ, প্রতিরোধ সব ভেসে গেছে, থেকে গেছে কেবল সমালোচনাটুকু। এমনকি এই সেদিনও বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত লিট ফেস্ট ২০১৭-তে আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছি যে, তিনি আমাদের পুরোধা লেখক, যিনি পথ দেখিয়েছেন, অনেক শব্দকে ছাপার অক্ষরে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিল, তিনি মুক্ত করে দিয়েছেন।’
তসলিমা নাসরিনের প্রতি আমার কোনো ধরনের বিদ্বেষ, রাগ কখনোই ছিল না বলে জানান সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টি। তিনি বলেন, বরং আমার দুঃসময়ে তিনি পাশে ছিলেন সেটা আমি ভুলিনি। তাই বলে তার প্রকাশিত বইয়ের সমালোচনা আমি করতে পারবো না সেটাতো হতে পারে না।
‘হতে পারে তিনি মনে করেছেন যে, আমার সমালোচনাটি কুৎসিৎ ব্যক্তি আক্রমণ, কিন্তু আমি নিজে জানি যে, তখনও আমি সেটা করিনি আর এখনতো আরও করবো না।’
মাসুদা ভাট্টি বলেন, তসলিমা নাসরিন তার মতামত দিয়েছেন আমার সম্পর্কে। আমি সে সম্পর্কে আমার ব্যাখ্যা দিতে পারি মাত্র, এর বেশি আর কীই বা করতে পারি।
এই নারী সাংবাদিক আরও বলেন, তবে এমন একটি সময়কে ২০ বছর আগে লেখা সমালোচনার জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন, যখন আমি কেবল আক্রান্তই নই, আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রশ্নটিও তিনি আমলে আনেননি, আমার চেয়ে তার এই নিরাপত্তা-সংকটের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি বোঝার কথা ছিল।
‘আজকে তার দেয়া চারিত্রিক সার্টিফিকেট নিয়ে যারা আমাকে তুলোধনো করছেন। তারাই প্রতিদিন তার মাথা চায়, নোংরা আক্রমণে জর্জরিত করে, কখনও বা তাকে দেশছাড়া করতে চায়’
তিনি বলেন, কিন্তু আজ আমার বিরুদ্ধে তারই দেয়া ‘ভীষণ চরিত্রহীন’ তকমার করাত দিয়ে আমাকে টুকরো টুকেরো করছে। জানি না, এতে কার লাভ কী হলো? কিন্তু কিছু একটা হলো নিশ্চয়ই।