অগ্নিঝরা মার্চ
বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়তে যুদ্ধ করেছিলাম

তোজাম্মেল হক
প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধারা বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ চেয়েছিলাম। পাকিস্তানিরা ছিল আমাদের জাতশত্রু। এ কারণে দেশের ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবনবাজি রেখে তাদের পরাস্ত করেছিল। আমাদের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল, সব বৈষম্যের অবসান ঘটবে। কিন্তু সেটি হয়নি। ৫৪ বছর আগে আমরা স্বদেশ পেয়েছিলাম। ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন দেশ পেলেও বন্ধ হয়নি হানাহানি আর রক্তপাত। বিজয়ের পরে শুরুতেই হয় এ দ্বন্দ্বের সূত্রপাত।
কিশোর বয়সেই বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানিদের অত্যাচার, নির্যাতন, অসম অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক অধিকারসহ তাদের নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ড আমার মনে প্রতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়। মাত্র ২০ বছর বয়সেই আমি ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া গ্রুপ) রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ি। রাজশাহী সিটি কলেজে বিএ কোর্সে পড়ার সময় কলেজ শাখার সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করি। পাকিস্তানিদের অত্যাচার আর নির্যাতনের প্রতিবাদে সক্রিয় হয়ে ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করতে মনোনিবেশ করি।
পাকিস্তানিদের নির্যাতনের প্রতিবাদে ৭১-এর মার্চে দেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। এপ্রিলের শুরুতে পাকিস্তানি বাহিনী রাজশাহী দখল করে। আমিও মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেই। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বিদিরপুর ঘাট দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলার পাহাড়পুর ইয়ুথ ক্যাম্পে চলে যাই। সেখানে সাত নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর গিয়াসের কাছে অন্যদের সঙ্গে সামরিক প্রশিক্ষণ নেই।
এরপর জুনের মাঝামাঝি সময়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের পার্শ্ববর্তী সীমান্ত এলাকা পোড়াদহতে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী স্থানীয় ব্যক্তিদের বাড়িতে বেশ কিছুদিন অবস্থান করি। আমার কাজ ছিল, সারা দিন বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী আলবদর ও রাজাকারদের গতিবিধি লক্ষ্য করা। তাদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা। আমি এসব তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে অত্যন্ত কৌশলে তাদের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করতাম। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের সুনির্দিষ্ট তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের জানাতাম। আমার তথ্যের ভিত্তিতেই মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসরদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। অধিকাংশ অপারেশনেই আমরা বিজয়ী হয়েছি।
এরপর আমি আবারও ইয়ুথ ক্যাম্পে ফিরে যাই। এ সময় আমি মেজর গিয়াসের সান্নিধ্য পাই। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। এছাড়া সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধা সোনাবাহিনীর সদস্য আব্দুল গফুরসহ অন্যদের সঙ্গে হৃদতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর মেজর গিয়াসের নির্দেশে আমরা সীমান্ত পার হয়ে গোদাগাড়ীর বিদিরপুর বারোমাইল সেতুতে অপারেশন করি। সেতুটি আমরা ধ্বংস করি। কারণ, এই সেতু দিয়েই রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের যে সড়ক সেটির সংযোগ রক্ষা করত। আর এ সড়কটিই ছিল পাকিস্তানি সেনাদের যোগাযোগ রক্ষার একমাত্র পথ। সেতুটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচলে চরম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন অপারেশনে এর বাড়তি সুবিধা লাভ করে। এরপরেও আমি কয়েকটি যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেই। চলে আসে আমাদের চরম কাঙ্ক্ষিত বিজয়ের ক্ষণ ১৬ ডিসেম্বর। আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালির কাছে আত্মসমর্পণ করে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা অর্ধশতকেরও বেশি সময় অতিবাহিত করেছি। যে স্বপ্ন আর উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম, সেটি অধরাই রয়ে গেছে। ৭১-এর বিজয়ের পর মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামী লীগ নিজেদের সম্পদ বলে মনে করেছে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বিধা-বিভক্ত করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্যাতন হয়েছে। আওয়ামী লীগের নির্যাতনে অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ দিয়েছেন। অথচ দলমত নির্বিশেষে দেশের ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ করেছেন। আওয়ামী লীগের কারণেই শুরু থেকে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। আওয়ামী লীগ যদি সবাইকে নিয়ে সমৃদ্ধ জাতি গড়ার কাজে ঐক্যবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করত, তাহলে আজ আমাদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব আর হানাহানি-এমন সময় দেখতে হতো না।
রাজনৈতিক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমরা ২৪ পেয়েছিলাম। ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণ-আন্দোলনে ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতার মসনদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর মানুষ নতুনভাবে স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে দেশের সর্বস্তরের জনতা হতাশ হয়েছে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং জনগণের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে সব ভেদাভেদ ভুলে এক প্ল্যাটফর্মে আসতে হবে। শুধু ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে, মহান মুক্তিযুদ্ধের যে ত্যাগ সেটির সঙ্গে মহা অন্যায় করা হবে। আর এটি হবে আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এ গণ্ডি থেকে বের হয়ে আমাদের সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ার জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। জীবন সায়াহ্নে এসে এটিই আমার কাছে এখন সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা।
সাবেক কার্যনির্বাহী সদস্য
গোদাগাড়ী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড, রাজশাহী