চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদে মুদ্রানীতি
লক্ষ্য থেকে বহুদূরে
আ.লীগ আমলে সব সূচকের প্রকৃত তথ্য গোপন করা হয়েছিল, যা এখন বেরিয়ে আসছে * রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সৃষ্ট অস্থিরতায় বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত, ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি মন্থর
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: যুগান্তর
চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদে ঘোষিত মুদ্রানীতির কোনো সূচকের লক্ষ্যমাত্রাই অর্জিত হয়নি। তিন দফায় নীতিসুদ হার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। বাজারে টাকার জোগান, অভ্যন্তরীণ ঋণ, সরকারি ঋণ, বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন থেকে বহুদূরে রয়েছে। নিট বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বা সম্পদ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রার যেমন ধারেকাছেও যাওয়া সম্ভব হয়নি, বরং কমেছে। নিট অভ্যন্তরীণ সম্পদের হার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম বেড়েছে। খেলাপি ঋণও কমানো সম্ভব হয়নি। উলটো আরও বেড়েছে। অন্যান্য সূচকেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, দেশে ও বৈশ্বিকভাবে বিদ্যমান পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আর্থিক খাতের নানা সূচকের প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসায় ও তা প্রকাশ করার কারণেই মূলত এমন চিত্র বেরিয়ে এসেছে। গত সরকারের আমলে মূল্যস্ফীতি, খেলাপি ঋণসহ প্রায় সব খাতের প্রকৃত চিত্র গোপন করা হয়েছিল। ফলে মূল্যস্ফীতির হার যেমন কমিয়ে দেখানো হয়েছিল, তেমনি জিডিপির প্রবৃদ্ধি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়। খেলাপি ঋণ কম দেখানোর পাশাপাশি ব্যাংক খাতের লুটপাটের চিত্র আড়াল করা হয়। যে কারণে মুদ্রানীতির প্রকৃত চিত্র মানুষের সামনে আসেনি। গত ৫ আগস্ট আওয়ায়ী লীগ সরকারের পতন হলে আর্থিক খাতের প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসতে শুরু করে। ফলে এখন মুদ্রানীতির প্রকৃত চেহারাও বেরিয়ে এসেছে। এছাড়া সরকার পরিবর্তনের পর সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের পালিয়ে যাওয়া, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিকবার বন্যার কারণেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেশি মাত্রায় সংকুচিত হয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করেছে।
গত ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে বৈশ্বিক মন্দা দেখা দেয়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। ফলে বেড়ে যায় পণ্যের দাম, ডলারের দাম, সংকট দেখা দেয় বৈদেশিক মুদ্রার। যার প্রভাবে বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি। যে ধারা এখনো চলমান রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে ২০২২ সালের জুলাই থেকেই সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করা শুরু হয়। যে ধারা এখনো অর্থাৎ আড়াই বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে। চলতি অর্থবছরের আগামী ছয় মাসের জন্যও সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হবে।
সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির প্রভাবে ঋণের সুদের হার বাড়ে, টাকার প্রবাহ কমে। ফলে ঋণপ্রবাহ হ্রাস পায়, বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হ্রাস পেয়ে প্রবৃদ্ধির গতি কমে যায়, কর্মসংস্থান বাড়ে না। অথচ বাংলাদেশের মতো দেশে বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান বাড়ানো জরুরি। কিন্তু আড়াই বছর ধরে এটি সম্ভব হচ্ছে না। দীর্ঘ সময় ধরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করলে অর্থনীতির চাকা গর্তে আটকে যেতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন প্রতি অর্থবছরের জন্য দুই দফায় মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। এর মধ্যে জুলাই-ডিসেম্বর প্রথমার্ধের। ওই নীতির বাস্তবায়ন ও দেশে এবং বিদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে জানুয়ারি-জুন মেয়াদে দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়। গত বছরের জুলাই মাসে চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়। ওই নীতিতে যেসব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল তার প্রায় সবই অর্জিত হয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। গত নভেম্বর পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে দশমিক ৩৭ শতাংশ। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে অর্জিত হয়েছিল দশমিক ১২ শতাংশ। যা ওই বছরের লক্ষ্যমাত্রার অনেক কম ছিল। তবে গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে টাকার প্রবাহ কিছুটা বেড়েছে।
দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। এর বিপরীতে গত নভেম্বর পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে অর্জিত হয়েছিল ১ দশমিক ৬০ শতাংশ। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে ঋণের প্রবাহ কিছুটা বেড়েছে। তবে দুই বছরেই তা লক্ষ্যমাত্রার অনেক নিচে ছিল।
মুদ্রানীতিতে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণের জোগান বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এর বিপরীতে গত নভেম্বর পর্যন্ত এ খাতে ঋণের বিতরণ বেড়েছে ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। মূলত রাজস্ব আদায় কমার কারণে ঋণ বেড়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ হয়নি বললেই চলে। গত অর্থবছরের একই সময়ে সরকারি খাতে ঋণের জোগান কমেছিল ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ।
আলোচ্য সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। গত নভেম্বর পর্যন্ত বেড়েছে ১ দশমিক ৪১ শতাংশ। যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়ে ছিল ৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে এ খাতে ঋণপ্রবাহ বেশি ছিল। তবে তাও ছিল লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশ কম। কয়েক বছর ধরেই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। এর জন্য দেশে ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিদ্যমান অস্থিরতা, দেশে ডলার সংকট ও এর দাম বৃদ্ধি, ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট, ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট, উদ্যোক্তাদের আস্থাহীনতাকে দায়ী করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে এসবের পাশাপাশি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সৃষ্ট অস্থিরতাকেও দায়ী করা হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কিন্তু গত ডিসেম্বরে এ হার ছিল ১০ দশমকি ৮৯ শতাংশ। আগামী জুনের মধ্যে এ হার ৭ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। সে লক্ষ্য নিয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করছে। গত অর্থবছরের ডিসেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণের জন্য চলতি অর্থবছরের আগস্ট থেকে অক্টোবর এই তিন মাসে তিন দফায় নীতি সুদের হার দশমিক ৫০ শতাংশ করে দেড় শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এ হার খুব একটা কমেনি।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ কাজ করা শুরু করেছে। এখন এ হার কমছে। আগামীতে আরও কমে যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশে নিট বৈদেশিক সম্পদ বা বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ এবার বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু বাস্তবে বাড়েনি, বরং তা আগের চেয়ে কমেছে। কয়েক বছর ধরেই বৈদেশিক মুদ্রার নিট প্রবাহ কমছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এ লক্ষ্যমাত্রা ২ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এটি বাড়েনি। এর বিপরীতে ১৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ কমেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে কমেছিল ১৬ দশমিক ০৯ শতাংশ। বকেয়া বা স্থগিত করা বৈদেশিক ঋণ বেশি মাত্রায় পরিশোধের কারণে এবং বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবে শুভঙ্করের ফাঁকি বন্ধ করায় এ খাতে ঘাটতি বেশি বেড়েছে।
বৈদেশিক খাতে রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয় বেড়েছে। বৈদেশিক অনুদান ও ঋণপ্রবাহ কমেছে। তবে আমদানি কমায় এ খাতে চাপ কমেছে। তবে ঋণ পরিশোধ বাড়ার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বেড়েছে। ফলে ডলার এখনও চাপে রয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে ২৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ২ দশমিক ৯২ শতাংশ। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেশি বেড়েছে। জুলাই-নভেম্বরে আমদানি ব্যয় কমেছে ১ দশমিক ১৯ শতাংশ। রপ্তানি আয় বেড়েছে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের চেয়ে খরচ কমায় চলতি হিসাবে ঘাটতি কমেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে এ খাতে ঘাটতি ছিল ৩৯৪ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৩ কোটি ডলারে।
দেশের ব্যাংক খাতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ ৯ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল আলোচ্য সময়ে। এর বিপরীতে বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ।