স্বজনের মুখটা শেষবারের মতো দেখতে দিলেন না বিমানের কর্তারা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:১১ পিএম
স্বজনের মুখটা শেষ দেখা দেখতে জার্মানি থেকে দেশে আসতে আবুধাবি বিমানবন্দরে পৌঁছান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জার্মান নাগরিক রেজাউল করিম সিদ্দিকী নিশাদ। সেখান থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় পৌঁছানোর কথা ছিল তার। আগেই কিনেছিলেন টিকিট। কিন্তু বিমানের সার্ভারে রেজাউলের নাম দেখাচ্ছে না- এমন দাবি করে তাকে ওই ফ্লাইটে উঠতে দেওয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে বিকল্প উপায়ে বাড়তি খরচ করে ৪৮ ঘণ্টা পর রেজাউল যখন দেশে আসেন ততক্ষণে হয়ে যায় তার স্বজনের দাফন। বিমান কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতা তাকে দেখতে দেয়নি স্বজনের মুখ। অথচ পরবর্তী সময়ে তার নামের টিকিটটি সার্ভারে পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ বিমানের তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে রেজাউল বলেন, ‘করোনা মহামারিতে আমি আমার ছোট বোনকে হারিয়েছি। মা হারা দুই শিশুসন্তানকে আগলে রেখেছিলেন তাদের নানা-নানি ও তাদের বাবা (বোনের স্বামী) জয়নাল আবেদিন লিটন। হঠাৎ লিটন গুরুতর অসুস্থ হয়ে মৃত্যু পথযাত্রী হওয়ার খবর শুনে গত ১০ জানুয়ারি দুপুরে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিই। এর কিছুক্ষণ আগেই লিটনের মৃত্যুর খবর পাই।’
আবুধাবিতে কর্মরত বিমানের কর্মকর্তাদের চরম দায়িত্বহীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতাকে দায়ী করেছেন রেজাউল করিম। তার অভিযোগ, বিমানের কর্মীরা তাকে কোনো ধরনের সহযোগিতা না করে উল্টো চরম দুর্ব্যবহার করেছেন। অবমাননাকর এই ঘটনার জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ১০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন তিনি।
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট) থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক পাশ করে দেশে কিছুদিন চাকরির পর জার্মানিতে পাড়ি জমান রেজাউল। সেখানে সেন্সর টেকনোলজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে সে দেশেই চাকরি শুরু করেন। বর্তমানে তিনি সপরিবারে জার্মান নাগরিক হিসেবে দেশটিতে বসবাস করছেন।
রেজাউল বলেন, ‘প্রথমে জার্মানির মিউনিক বিমানবন্দর থেকে গ্রিস, এরপর সেখান থেকে আরেকটি ফ্লাইটে আবুধাবি বিমানবন্দরে পৌঁছাই। সেখান থেকে ১১ জানুয়ারি স্থানীয় সময় রাত পৌনে ৩টায় বিমানের একটি ফ্লাইটে (বিজি ৩২৮) ঢাকায় পৌঁছানোর জন্য আগে থেকেই টিকিট (নম্বর ৯৯৭৩৪৯৬১৮৪৮৩৭) কিনেছিলাম। কিন্তু বিমানবন্দরে বিমানের কাউন্টারে গিয়ে বোর্ডিং পাশ সংগ্রহ করতে গেলে সেখানে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা (বাংলাদেশি নাগরিক) জানান, আমার নামে কোনো টিকিট নাকি তাদের সার্ভারে নেই।’
‘চরম উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যেও তাদের নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি, মৃত ভাইয়ের কথা বলি, আমার টিকিটের সপক্ষে নানা প্রমাণ দেখাই। কিন্তু কিছুতেই তাদের মন গলেনি। উল্টো চরম দুর্ব্যবহার করেন। একপর্যায়ে তাদের বললাম আমি জার্মানি থেকে আরও দুটি ফ্লাইটে এসেছি। টিকিট ছাড়া তো আসা সম্ভব নয়। তাদের ফ্লাইটের বোর্ডিং পাশ সংগ্রহের জন্য শুধু আমার নাম বললেই তারা তা দিয়েছে। আপনারাও আমার নাম দিয়ে একটু খুঁজে দেখতে পারেন। একথা শুনেই বিমানের একজন কর্মকর্তা লাফ দিয়ে উঠে বলেন, আপনার কাছে কি আমার কাজ শিখতে হবে? যান...। একপর্যায়ে ওই কর্মকর্তা তার আসন ছেড়ে চলে গেলেন’- যোগ করেন রেজাউল।
বিমানের কর্মকর্তারা রেজাউলের সঙ্গে এমন আচরণ করে যখন এক প্রকার তাড়িয়ে দেন, তখন রাত আড়াইটা। চরম বিপাকে পড়েন তিনি। কারণ, বাংলাদেশে ফেরার পরবর্তী ফ্লাইট পরদিন মধ্যরাতে। আবুধাবিতে কয়েকজন পরিচিতজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেও ব্যর্থ হলেন। কারণ, তখন সবাই ঘুমিয়ে।
রেজাউল বলছিলেন, ‘প্রায় ১২ ঘণ্টার জার্নি, তার ওপর স্বজন হারানোর ব্যথা। এর মধ্যে বিমানের কর্মকর্তাদের এমন দায়িত্বহীনতায় আমি হতবাক ছিলাম। আমার তখন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। পাগলের মতো বিমানবন্দরের ভেতর হাঁটছি। একপর্যায়ে সেখানে একজন বাংলাদেশির সঙ্গে দেখা হলো। তার পরামর্শে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ১৫০ কিলোমিটার দূরে দুবাই গেলাম। দুবাই বিমানবন্দরে পরিচিত একজনের সঙ্গে যোগাযোগের পর রাত সাড়ে ৯টায় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে নতুন করে টিকিট কিনতে হয় আমার। ওই ফ্লাইটে ঢাকায় পৌঁছে নিজ বাড়ি টাঙ্গাইল গিয়ে দেখি লিটনের দাফন শেষ।’
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এ জার্মান নাগরিক বলেন, ‘নিজের মানসিকতা একটু স্বাভাবিক হলে কয়েক দিন পর ঢাকার ফার্মগেটে বিমানের কার্যালয়ে বলাকায় গিয়ে অভিযোগ করি। সেখান থেকে আমাকে মতিঝিলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার পর মতিঝিলে বিমানের এক কর্মী আমার পিএনআর নম্বর দিয়ে চেক করে বলেন আপনার নামে টিকিট তো ছিল। সেটা এখনো সার্ভারে দেখাচ্ছে। একপর্যায়ে আমার অনুরোধে তিনি একটি প্রিন্ট কপিও আমাকে দিলেন।এ সময় বিমানের ওই কর্মীর কাছে রেজাউল যখন জানতে চাইলেন তখন তার বক্তব্য ছিল- এজন্য আসলে আবুধাবিতে কর্মরত বিমানের কর্মকর্তারাই দায়ী।’
রেজাউল বলেন, ‘আমার পরিবারের সবাই আজীবন বহন করবে এই অসহ্য যন্ত্রণা। বিশেষ করে যখন করোনায় মা হারানো আমার এতিম দুই ছোট ভাগ্নি, বাবা হারানোর বেদনা আর কষ্টে জর্জরিত, তখন তাদের বুকে জড়িয়ে ধরার সুযোগ থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছি।’
‘জার্মানিতে ১২ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা শুধু আমার ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডিই নয়, সম্মানিত সব রেমিট্যান্সযোদ্ধার জন্য শোকের ও লজ্জার।একই সঙ্গে আমরা বিদেশে পড়ে থেকেও যাদের আত্মা এ দেশের আলো-বাতাস-মাটিতে পড়ে থাকে, সেই বাংলাদেশের জন্য এটি একটি লজ্জা ও কলঙ্কময় ঘটনা’- যোগ করেন তিনি।
ক্ষুব্ধ কণ্ঠে রেজাউল বললেন, ‘বাংলাদেশ বিমানের অব্যবস্থাপনা আর স্বেচ্ছাচারিতায় শেষবার ভাইয়ের মুখখানি তো দূর, শেষ বিদায়ের জানাজায় পর্যন্ত থাকতে পারিনি। আমি চাই, আমার বোনজামাইয়ের মৃত্যু ব্যর্থ না হোক। আমি এ ঘটনার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার চাই। আমি চাই, আমার মতো আর কেউ যেন এমন অসহনীয়-অপূরণীয় ক্ষতির শিকার না হয়।’
এ ঘটনার প্রতিকার চেয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন বলেও জানান তিনি। বিমানকর্মীদের এমন আচরণের বিষয়টি রেজাউল তার নিজের ফেসবুকে শেয়ার করার পর বহু মানুষ তা শেয়ার করেছেন, দেখিয়েছেন সমবেদনা। সেই সঙ্গে বিমানকর্মীদের এমন দায়িত্বহীন কাণ্ড যে এটিই প্রথম নয়, তাও মন্তব্য করেছেন তারা। অনেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে বয়কটের ডাকও দিয়েছেন।
এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চেয়ারম্যান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।