মিট দ্য প্রেসে ডিএমপি কমিশনার
রাজনৈতিক পরিচয়ে ১৫ বছরে পুলিশে নিয়োগ ৯০ হাজার
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:১০ পিএম
বাবা, মা, দাদা, তার দাদাসহ চৌদ্দপুরুষের রাজনৈতিক পরিচয় খুঁজে গত ১৫ বছরে পুলিশ বাহিনীতে ৮০ থেকে ৯০ হাজার লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মানবিক কারণে চাইলেই এ ৮০-৯০ হাজার পুলিশ সদস্যকে বলা যায় না গো ব্যাক হোম (বাসায় ফিরে যাও)। তবে যারা দুষ্ট, যারা পেশাদারির বাইরে গিয়ে নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়েছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সোমবার রাজধানীর মিন্টুরোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী এসব কথা বলেন।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের বিতর্কিত ভূমিকার জন্য ক্ষমা চেয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, পেশাদারির বাইরে গিয়ে পুলিশ যে কাজ করেছে, এর জন্য দুঃখিত। ঢাকা ও দেশবাসীর কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ডিএমপির যেসব পুলিশ অপেশাদার কাজ করেছে, তাদের ইতোমধ্যে বদলি ও প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যখন পুলিশ ইনঅ্যাক্টিভ হয়ে পড়ে, তখন ঢাকা শহরে ডাকাতি, লুটপাট শুরু হয়। তখন দেখেছি ৮০ বছরের বৃদ্ধও লাঠি নিয়ে পাহারা দিয়েছেন। তখন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ট্রমার মধ্যে পড়ে যায়। এরপর সদ্যবিদায়ি ডিএমপি কমিশনারসহ অন্যরা পুলিশকে সক্রিয় করতে কাজ শুরু করেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতের ঘটনায় মামলা নিয়ে বাণিজ্য হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারা দেশে মিথ্যা মামলা দিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হয়রানির ঘটনা বেড়েছে। যেসব লোকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হচ্ছে, তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের গ্রেফতার করা হবে না।
তিনি বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরে অধিকাংশ মামলা হয়েছে কোর্টের নির্দেশে। এখানে আসামি সংখ্যা ছিল ২০০ প্লাস। দেখা যাচ্ছে এসব মামলায় অনেকে জড়িত ছিল না, গুটিকয়েক লোক জড়িত ছিল। কিন্তু এখন যেটা ঘটছে, ওই মামলার বাদী একশ লোকের কাছে গিয়ে টাকা দাবি করছে। এমন আসামিদের ভয়ের কিছু নেই, তাদের অ্যারেস্ট করা হবে না। তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টতা আসবে, আমরা শুধু তাদের গ্রেফতার করব। চাঁদাবাজি বাণিজ্যটা করবেন বলে বাদী উদ্দেশ্যমূলকভাবে দুইশ লোককে আসামি করেছে।
মামলার বাদী ছাড়াও পুলিশেরও কিছু লোক অনৈতিক কাজ করছে জানিয়ে কমিশনার বলেন, আমার সব লোকও যে ভালো তা বলব না। আমার কাছে যাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। আমি রোববার অলরেডি একজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি, যিনি আমার লোক, এ কাজে লিপ্ত ছিল। চাঁদাবাজ যেই হোক, বাদী হোক আর আমার লোক (পুলিশ) হোক-যারাই আসামির কাছে চাঁদাবাজি করছেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। শিগ্গিরই তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।
নগরবাসীর প্রতি অনুরোধ, কেউ আপনারা চাঁদা দেবেন না। চাঁদার কারণে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সমাজ থেকে যদি প্রতিবাদ গড়ে তোলা না হয়, তাহলে বন্ধ করা সম্ভব না। নগরবাসীর সহযোগিতা ছাড়া আমরা কিছু করতে পারব না।
ট্রাফিক ব্যবস্থায় জোর দেওয়া হয়েছে জানিয়ে কমিশনার বলেন, বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা। ট্রাফিক আইন কেউ মানতে চান না। হকাররা ফুটপাত দখল করে নিয়েছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কাজ শুরু করেছি। ট্রাফিক আইনে দ্বিগুণ হারে মামলা হচ্ছে। ঢাকাবাসীর সহযোগিতা ছাড়া ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নত হবে না। স্কুল-কলেজের পাশে অভিভাবকদের বাসা ভাড়া নেওয়ার অনুরোধও জানিয়েছেন কমিশনার। পাশাপাশি ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার কমানোর অনুরোধও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘বিগত সরকার অটোরিকশার অনুমতি দেওয়ার কারণেই বাড়ছে অটোর সংখ্যা। অচিরেই এটি কমানো না গেলে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে নগরবাসীকে। এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছি। অটোরিকশা যদি বন্ধ না হয়, তাহলে ঢাকা শহরে ঘর থেকে বের হলে আর হাঁটার জায়গা থাকবে না। মানুষের মুভমেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে।
থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পর পুলিশ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগে জিডি হওয়ার ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা পর তদন্তকারী কর্মকর্তা যোগাযোগ করতেন বা ঘটনাস্থলে যেতেন। কিন্তু এখন সেসময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। জিডি নথিভুক্ত হওয়ার দুই থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে অফিসার যেভাবেই হোক ঘটনাস্থলে যাবেন বা অভিযোগকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, এ ব্যবস্থা চালু হবে। তিনি অভিযোগকারীর বক্তব্য শুনবেন, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন। মামলা নেওয়ার মতো ঘটনা হলে অভিযোগকারীকে থানায় ডেকে নিয়ে মামলা গ্রহণ করবেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা নিযুক্ত করবেন।
তিনি আরও বলেন, ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে ডিএমপিতে এই ব্যবস্থা চালু হবে। সেজন্য নতুন লোক প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। এক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের থানায় থানায় পাঠানো হবে।
মামলার বিষয়ে উদাহরণ দিয়ে কমিশনার বলেন, তেজগাঁও থানায় ৫০০ মামলা হোক, সমস্যা নেই। সেজন্য আমি কমিশনার জবাবদিহি করব। কেন ৫০০ মামলা হলো, সেটার জবাব আমি দেব। মামলা হোক, জিডি হোক, সমস্যা নেই; কিন্তু কোনো ঘটনা যেন হাইড না থাকে। যে ঘটনায় মামলা হওয়ার কথা, সেটার জন্য মামলাই নিতে হবে। যেটার জন্য জিডি নেওয়ার কথা, সেটার জিডিই হতে হবে।
ছিনতাইয়ের ঘটনা অহরহ হচ্ছে জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, বিভিন্নভাবে আমাকে জানানো হয়েছে ছিনতাই বেড়েছে। ছিনতাই প্রতিরোধে ডিবি ও থানা পুলিশকে সক্রিয় করা হয়েছে।
তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টের ঘটনায় পুলিশ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। শিগ্গিরই ডিএমপিকে সচল করতে সক্ষম হব। নগরবাসীর সমস্যা ও অভিযোগ শুনতে ডিএমপি সদর দপ্তরে একটি অভিযোগ সেল খোলা হবে। পাশাপাশি দ্রুতই ওপেন ডে আয়োজন করে নগরবাসীর সমস্যা ও পুলিশের সেবার পরামর্শ নেওয়া হবে।