সংবিধান সংশোধনের ম্যান্ডেট কি অন্তর্বর্তী সরকারের আছে?
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৩ পিএম
‘একদফা ঘোষণার দিনই সংবিধান বাতিল হয়ে গেছে’ এবং ‘সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ এই সরকারই বাস্তবায়ন করবে’- প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য মাহফুজ আলমের এমন বক্তব্যের পর বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে যে এটি বাস্তবায়নের ম্যান্ডেট এবং এখতিয়ার বর্তমান সরকারের আছে কি না।
এই মুহূর্তে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী বলছে, সংবিধান সংশোধন করা কিংবা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের এখতিয়ার ও ম্যান্ডেট একমাত্র জাতীয় সংসদের। এমনকি উভয় দলই মনে করে সংবিধান সংশোধন হবে নাকি নতুন করে লেখা হবে- সেটিও শুধুমাত্র সংসদের এখতিয়ার।
প্রসঙ্গত, অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যেই সংস্কার প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করার জন্য কাজ শুরু করেছে।
সম্প্রতি আলী রীয়াজ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন- জনগণ, রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি ও আন্দোলনে প্রাণ দেওয়া মানুষের পক্ষের বক্তব্য শুনে তারা ঠিক করবেন সংবিধানের কোন কোন দিকে তারা দৃষ্টি দেবেন।
ওই সংবাদ সম্মেলনেই সংস্কার কমিশনের সুপারিশ কার্যকর বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ আলম বলেন, ‘এটা পলিটিক্যাল ডিসিশান। অবশ্যই এ সরকার করবে। কেন করবে না? এ সরকার না করলে আর কেউ করবে না। এটা অভ্যুত্থান ঘোষণার দিন, যেদিন একদফা ঘোষণা করা হয়েছে সেদিনই বাতিল। ওখানে বলা হয়েছে পুরো পলিটিক্যাল সেটেলমেন্ট আমরা খারিজ করছি। এর মানে হলো নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত মানেই নতুন সংবিধান।’
এরপর থেকেই বিতর্ক জোরালো হয়ে উঠেছে যে, সংবিধান সংশোধনের মতো একটি বিষয়ে বর্তমান সরকারের ম্যান্ডেট আছে কি না।
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের যা দাবি ছিল তা পূরণ হয়েছে। সংস্কারের ম্যান্ডেট তাদের ছিল না।’
আর জামায়াত ইসলামী বলছে, সরকার সংবিধানের বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারে না, এমনকি সংবিধান সংশোধন নাকি পুনর্লিখন হবে সেটিও ঠিক করবে নির্বাচিত সংসদ।
ভবিষ্যতে স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো থেকে বের হয়ে আসার জন্য সংবিধানের সংস্কার বা পরিবর্তন আনার প্রয়োজনীয়তা বিভিন্ন মহল থেকেই আসছে। তবে বিতর্ক হচ্ছে যে সংবিধান সংশোধন করা হবে নাকি নতুন করে লেখা হবে।
আবার সংস্কার কমিশন যেসব সুপারিশ করবে সেটি কে বাস্তবায়ন করবে তা নিয়েও আলোচনা আছে। দলগুলো সংসদের কথা বললেও নির্বাচনের পরে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ শতভাগ গ্রহণ করা হয় কি না- তা নিয়েও কারো কারো ভিন্নমত আছে।
সংবিধান সংস্কারে কমিশনের সংবাদ সম্মেলনে মাহফুজ আলম বলেন, ‘একদফার ঘোষণায় তারা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলেছেন আর নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত মানেই নতুন সংবিধান।’
তবে মূলত শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে সংবিধান বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য আন্দোলনকারীদের দিক থেকে আসেনি। ওই সরকারের পতনের পর থেকে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ সংবিধান নতুন করে তৈরির ধারণা সামনে নিয়ে আসেন।
একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে এটি সামনে আনেন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির একজন নেতা। এরপর এটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন নেতাও বলতে শুরু করেন।
পরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবনা তুলে ধরতে অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেন।
রোববারের সংবাদ সম্মেলনে আলী রীয়াজ জানান, আগামী সপ্তাহ থেকে রাজনৈতিক দল বাদে অন্য অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করবেন তারা।
লিখিত বক্তব্যে তিনি তখন বলেছিলেন, ‘জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনের লক্ষ্যে সংবিধানের সামগ্রিক সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জন, পুনর্বিন্যাস এবং পুনর্লিখনের বিষয় আসবে।’
এই সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বর্তমান সরকারই বাস্তবায়ন করবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম জানান, এগুলো এই সরকারই বাস্তবায়ন করবে।যদিও কিভাবে করবে- তা নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি তিনি।
এই ঘোষণা সামনে আসার পর সংবিধান ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন ও রাজনৈতিক নেতারা।
সোমবার ঢাকায় গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির ‘সংবিধান দিবস’ উপলক্ষে আলোচনা সভায় সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল চাকরিতে বৈষম্য দূর করা, সেটা হয়েছে।রাষ্ট্রের সংস্কার করা তাদের (শিক্ষার্থীদের) ম্যান্ডেট ছিল না। এটা সংসদের কাজ। সংবিধান সংশোধন করলে কতগুলো জটিলতার সৃষ্টি হবে। সংবিধান বিতর্ক জাতিকে সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বিতর্ক হলে অনেক ষড়যন্ত্র হবে। অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে।
ওই সভাতেই বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ড. কামাল হোসেন বলেন, সংবিধান পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন কিন্তু কোনো ব্যক্তির কলমের খোঁচায় সংবিধান বদলাবে না।
ওই আলোচনা সভায় সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিকও উপস্থিত ছিলেন।
একদফার ঘোষণাপত্রে কী বলা হয়েছিল
সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা সরকারবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে গত ৩ আগস্ট সরকার পতনের একদফা ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম (বর্তমান তথ্য, ডাক ও টেলিযোগাযোগ উপদেষ্টা) একদফার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন। সেখানে বলা হয়েছিল-
‘যেহেতু, বর্তমান সরকারের নির্দেশে নির্বিচারে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, নারী-শিশু-ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক কেউ এ গণহত্যা থেকে রেহাই পাননি;
যেহেতু, সরকার এ হত্যাযজ্ঞের বিচার করার পরিবর্তে নির্বিচারে ছাত্র-জনতাকে গ্রেফতার ও নির্যাতন করছে;
যেহেতু, সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে হত্যাযজ্ঞ সংঘটন করেছে;
যেহেতু, ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক-মজুরসহ আপামর জনগণ মনে করছে এ সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ বিচার এবং তদন্ত সম্ভব নয়;
সেহেতু, আমরা বর্তমান স্বৈরাচারী সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবি ঘোষণা করছি।
একইসঙ্গে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি গ্রহণযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানাচ্ছি।’
রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে দেখছে
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সেটি করার কোনো এখতিয়ার নেই। বরং এটি করবে জনগণের নির্বাচিত সংসদ। এর আগে কার্যকরের কোনো সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, ‘আমরা হয়তো কোনো কোনো বিষয়ে একমত হবো। প্রধান উপদেষ্টা তো বলেছেন- জানুয়ারিতে তিনি আলোচনা করবেন এ বিষয়ে দলগুলোর সঙ্গে। তখন হয়তো সবাই আলোচনা করে যেসব বিষয়ে সংশোধন আনা যেতে পারে সেগুলো ঠিক করতে পারে। পরে জাতীয় সংসদ হলে নির্বাচিত সংসদ সংশোধনীগুলো গ্রহণ করবে। এটাই সংবিধান সংশোধনের একমাত্র প্রক্রিয়া।
এক প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন বলেন, তারা সংবিধানের ‘গণতান্ত্রিক সংশোধন চান’। আমরা এখন আমাদের প্রস্তাবনা গুলো নিয়ে কাজ করছি। সেগুলো চূড়ান্ত করে আমরা সংস্কার কমিশনে দেব। এর মধ্য দিয়ে আমরা জাতির সামনে একটা অঙ্গীকার করতে পারি যে এসব বিষয় আমরা বাস্তবায়ন করব।
সংবিধান সংশোধন কার্যকরের ম্যান্ডেট অন্তর্বর্তী সরকারের আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, কিছু লোক ডকট্রিন অব নেসেসেটি হিসেবে সরকার গঠন করে ক্ষমতায় আছে কিন্তু তা দিয়ে তো সব কিছু করা যাবে না।সংবিধানের বাইরে গিয়ে তারা কিছু করতে পারে না। জামায়াত মনে করে কিছু বিষয় সংশোধিত হওয়া দরকার। তবে এটা সংসদে হতে হবে।
তিনি বলেন, সংস্কার প্রস্তাবগুলো নির্বাচনের আগে সবার মতের ভিত্তিতে ঠিক করা দরকার। কিন্তু এসব কিছুই অনুমোদিত হতে হবে জাতীয় সংসদে। এমনকি সংবিধান সংশোধন নাকি পুনর্লিখন হবে- সেটিও জনগণের নির্বাচিত সংসদই ঠিক করবে।সূত্র: বিবিসি