বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক সায়মা ওয়াজেদকে নিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ‘নজিরবিহীন’ এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তারা সায়মা ওয়াজেদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী নয় এবং সরাসরি ডব্লিউএইচও-এর মূল অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। প্রেস উইং সূত্রে জানা গেছে, এ ব্যাপারে ডব্লিউএইচও’র কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠিও পাঠানো হয়েছে। সায়মা ওয়াজেদের মা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, গত ৫ অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর ভারতে পালিয়ে যান এবং এরপর থেকে তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সায়মা ওয়াজেদকে এড়িয়ে কাজ করতে পারবে?
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোনো আঞ্চলিক পরিচালককে নিয়ে অতীতে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে কাঠামো অনুসরণ করে সেখানে আঞ্চলিক পরিচালককে পাশ কাটিয়ে সরাসরি সদরদপ্তরের সাথে কাজ করার সুযোগ আছে কি না?
লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ-এর জনস্বাস্থ্য বিভাগের ভিজিটিং অধ্যাপক কেন্ট বিউস বিবিসি বাংলাকে বলেন, কোনো দেশ যদি চায় সেক্ষেত্রে তারা আঞ্চলিক অফিসকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি ডব্লিউএইচও সদরদপ্তরের সঙ্গে কাজ করতে পারে। বিভিন্ন দেশ সেটা করে থাকে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘সব দেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য। তারা কোনো আঞ্চলিক কমিটির সদস্য নয়। সুতরাং এটা কোনো ইস্যু নয়।’
তিনি আরও বলেন, এমন অবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে এ ধরনের অনুরোধ করা বাংলাদেশের জন্য যুক্তিযুক্ত।
তবে অধ্যাপক বিউস মনে করেন, সায়মা ওয়াজেদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে সেগুলো আরও সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। সেক্ষেত্রে ‘দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নিরপরাধ’ নীতি অবলম্বন করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
সায়মা ওয়াজেদকে নিয়ে অতীত বিতর্ক
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদের জন্য বাংলাদেশের তরফ থেকে যখন সায়মা ওয়াজেদকে মনোনীত করা হয় তখন সেটি নিয়ে বেশ বিতর্ক তৈরি হয়েছিল।
এই পদের জন্য তিনি কতটা ‘উপযুক্ত’ সে প্রশ্ন উঠেছিল বিভিন্ন জায়গায়।
চিকিৎসা বিষয়ক বিশ্বখ্যাত সাময়িকী দ্য ল্যানসেট ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক সম্পাদকীয়তে সায়মা ওয়াজেদ-এর মনোনয়ন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদে নির্বাচন হয় প্রতি পাঁচ বছর পর। সদস্য রাষ্ট্রগুলো তাদের প্রার্থী মনোনীত করে এই নির্বাচনের জন্য। প্রতিটি অঞ্চল স্বতন্ত্রভাবে তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনা করে।
ল্যানসেট-এর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, কয়েকটি অঞ্চলে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া প্রার্থীরা এই পদের জন্য উপযুক্ত কি না সেই প্রশ্নও রয়েছে।
এর ফলে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ যেমন রয়েছে তেমনি আঞ্চলিক পরিচালকদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদে বাংলাদেশ যে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে সেখানে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তোলা হয়েছে। কারণ প্রার্থী ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদের জন্য সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সাথে আরেকজন প্রার্থী ছিলেন নেপালের সম্ভু আচার্য।
সম্ভু ছিলেন বিশ্বসাস্থ্য সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, যিনি ৩০ বছর যাবত সেখানে কাজ করছেন। এছাড়া জনস্বাস্থ্যের ওপর তার পিএইচডি ডিগ্রি রয়েছে।
অন্যদিকে, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কাজ করতেন। তার বেশিরভাগ কাজ ছিল অটিজম নিয়ে।
ব্রিটেনের ফাইনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকার ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক প্রতিবেদনে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের মনোনয়ন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল।
এই পদের জন্য সায়মা ওয়াজেদ কতটা উপযুক্ত সে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল ফাইনান্সিয়াল টাইমস-এর প্রতিবেদনে।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়, সায়মা ওয়াজেদ স্কুল সাইকোলিজস্ট হিসেবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং তিনি একটি দাতব্য ও গবেষণা সংস্থা দেখাশোনা করেন। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় বড় বাজেট নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা তার নেই।
নির্বাচনের আগে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সফরে তার মা এবং বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। এসব সফরের মধ্যে ছিল নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন, দিল্লিতে জি-২০ সামিট।
এসব সফরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের তার দেখা হয়েছিল। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন ছবি সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারও করেছিলেন সায়মা ওয়াজেদ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালকের পদটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আঞ্চলিক পরিচালক ১১টি দেশের দুইশ কোটি মানুষের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বাজেট দেখাশোনা করেন।
এই ১১টি দেশ হচ্ছে– বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, উত্তর কোরিয়া, পূর্ব তিমোর।
জটিলতা তৈরি হবে?
বাংলাদেশের একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন বিভিন্ন সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন।
মুশতাক বলেন, কোনো আঞ্চলিক পরিচালককে নিয়ে তার নিজ দেশের ভেতর থেকে আপত্তি ওঠার বিষয়টি একেবারেই নতুন। অতীতে এ ধরনের নজির দেখা যায়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
জনস্বাস্থ্যের বিবেচনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জনসংখ্যার দিক থেকে এই ১১টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আঞ্চলিক পরিচালককে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের দিক থেকে যে আপত্তি উঠেছে সেটির নিরসন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে করতে হবে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সাধারণত রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করে না।
মুশতাক হোসেন বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বর্তমান মহাপরিচালক টেড্রোস অ্যাধনম ঘেব্রেইয়েসাস সম্পর্কে তার নিজ দেশ ইথিওপিয়ার দিক থেকে আপত্তি তোলা হয়েছে। ইথিওপিয়ায় সরকার-বিরোধীদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল টিগ্রের অধিবাসী ঘেব্রেইয়েসাস।
২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিগ্রে অঞ্চলের বিরোধীদের সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের যোগাযোগ রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ইথিওপিয়ার সরকার। বিষয়টি তদন্ত করার আহবান জানানো হয়েছিল ইথিওপিয়ার সরকারের তরফ থেকে।
মুশতাক হোসেন বলেন, তারপরেও ঘেব্রেইয়েসাসের দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক হিসেবে নির্বাচিত হতে কোনো সমস্যা হয়নি।