Logo
Logo
×

অন্যান্য

তিস্তা প্রকল্প: হাসিনার পতনে কমছে ভারতের সম্ভাবনা, এগিয়ে চীন

Icon

হামিদ-উজ-জামান

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৪০ এএম

তিস্তা প্রকল্প: হাসিনার পতনে কমছে ভারতের সম্ভাবনা, এগিয়ে চীন

রংপুর অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের প্রকল্প তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন নিয়ে এই মুহূর্তে কোনো তৎপরতা নেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। কিন্তু সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে ভারত ও চীন। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতের অর্থায়নের সম্ভাবনার বিষয়টি ক্ষীণ হয়ে এসেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিপরীতে এই প্রকল্পের নিজেদের যুক্ত করার ক্ষেত্রে প্রত্যাশা জেগেছে চীনের। কেননা প্রথম পর্যায়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রস্তাব দিয়েছিল চীন। পরবর্তীতে প্রস্তাব দেয় ভারতও। তবে শেষ পর্যন্ত তৃতীয় কোনো উৎস থেকে অর্থায়নের সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানাগেছে।

সূত্র জানায়, গত ৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বর্তমান সরকারের একনেক (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) বৈঠকে অনুমোদন পায় মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পটি। এটি বাস্তবায়নে দীর্ঘদিন ভারত ও চীনের মধ্যে টানাটানি ছিল। কিন্তু সর্বশেষ এই দুই দেশকে বাদ দিয়ে জাপানের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে ওই দিন তিস্তা মহাপরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের কাছে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এই মুহূর্তে তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে ভাবা হয়নি। ভারত ও চীনের প্রস্তাব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেখা যাক সামনে কী করা যায়।

এ প্রসঙ্গে ইআরডির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, চীন তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে অর্থায়ন করতে মুখিয়ে আছে। এই প্রকল্পে ব্যাপক আগ্রহ চীনের থাকলেও ভারত চেয়েছিল এটি যেন ভারতকেই দেওয়া হয়। এ অবস্থায় আওয়ামী সরকার এই দুটি দেশের কাউকেই অখুশি করাতে না পেরে প্রকল্পটি ঝুলিয়ে দেয়। কিন্তু এখন চীন মনে করে তারা এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেতে পারে। সরকার পতনের পর ভারতকে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে যুক্ত করার সম্ভাবনা কমে এসেছে। তবে অর্থায়নের উৎস যেখান থেকে আসুক না কেন, রংপুর অঞ্চলের মানুষের জন্য এটি একটি অপরিহার্য মহাপরিকল্পনা। জনস্বার্থে এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন জরুরি। তবে এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এখনো ইআরডিকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।

সূত্র জানায়, চীনের প্রস্তাবিত ‘তিস্তা প্রকল্প’ বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার মানুষের ভাগ্য। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। নদীর গভীরতা প্রায় ১০ মিটার বাড়বে। বন্যার পানি প্লাবিত হয়ে ভাসাবে না গ্রামগঞ্জের জনপদ। সারা বছর নৌ চলাচলের মতো পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা যাবে। এতে আছে ১০৮ কিলোমিটার নদী খনন, নদীর দুপাড়ে ১৭৩ কিলোমিটার তীর রক্ষা, চর খনন, নদীর দুই ধারে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ, বালু সরিয়ে কৃষিজমি উদ্ধার ও ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা এবং প্রতি বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন। নৌ-বন্দর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দুই পাড়ে থানা, কোস্টগার্ড ও সেনাবাহিনীর জন্য ক্যাম্পের ব্যবস্থার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে প্রকল্পটিতে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি মাসখানেকের মতো এই মন্ত্রণালয়ের যোগ দিয়েছি। খুব বেশি কিছু জানি না। তবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বিষয়ে যেটুকু মনে পড়ে চীনের একটি বিস্তারিত স্টাডি করে জমা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটি এখনো দেয়নি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে এ মহাপরিকল্পনার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা এখনো আসেনি। এ নিয়ে আপাতত কোনো কাজও করা হচ্ছে না।

জানা যায়, প্রায় ২৪০ বছরের পুরোনো নদী তিস্তা। এর সঙ্গে রয়েছে উত্তরের ২৫টি নদীর প্রবাহ। শুষ্ক মৌসুমে নদীটি একেবারেই শুকিয়ে যায়। নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম জেলার রাজাহাট, উলিপুর, চিলমারী, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে নদীটি। তবে শুষ্ক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা। এ উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে সাতটিই তিস্তা নদীবেষ্টিত। নদীশাসন না হওয়ায় গত পাঁচ বছরে গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে তিস্তা পাড় হয়ে উঠবে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মতো সুন্দর নগরী। চীনের হোয়াংহো নদীকে একসময় বলা হতো চীনের দুঃখ। প্রতি বছর ওই নদীর পানি ভাসিয়ে দিত শত শত মাইল জনপদ। ভেঙে নিয়ে যেত বহু গ্রাম-পথ-ঘাট জনপদ। সেই সর্বনাশা নদীশাসন করায় (পরিকল্পিত ড্রেজিং) চীনের মানুষের দুঃখ ঘুচেছে। হোয়াংহো এখন হয়ে গেছে চীনের কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ। হোয়াংহোর মতোই এখন বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চলের ‘পাগলা নদী’ খ্যাত তিস্তা ড্রেজিং করে কোটি মানুষের দুঃখ ঘোচানো সম্ভব বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং চীনের পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না বা পাওয়ার চায়নার মধ্যে ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। মহাপরিকল্পনায় পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তার দুই পাড়ে পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলার প্রাথমিক প্রস্তাব করা হয়। সরকার চীনের সেই প্রস্তাবনার আলোকেই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলেছিল।

সূত্র জানায়, চলতি বছরের শুরুতে ভারত সফর করেন পতিত আওয়ামী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময় দিল্লিতে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশকে সংযুক্ত করেছে ৫৪টি নদী। বন্যা ব্যবস্থাপনা, আগাম সতর্কতা, পানীয় জলের প্রকল্পের ক্ষেত্রে আমরা সহযোগিতা করছি। ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি চুক্তি নবায়নের বিষয়ে কারিগরি পর্যায়ের আলোচনা শুরুর সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি। বাংলাদেশে তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আলোচনার জন্য একটি কারিগরি দল শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে। এরপর সেই কারিগরি দলের আর আসা হয়নি।

পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) মো. জাহাঙ্গীর আলম যুগান্তরকে বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে এখনো কোনো প্রকল্প আমাদের কাছে আসেনি। কিংবা এ নিয়ে কোনো আলোচনাও শুনিনি। তবে তিস্তা নিয়ে ছোট একটা প্রকল্প চলমান আছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম