যুগান্তরকে মজিবুর রহমান মঞ্জু
সবাইকে নিয়েই সংস্কার ও নির্বাচনের সমাধান
তারিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:১৪ এএম
মজিবুর রহমান মঞ্জু।
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, আন্দোলনে তারা যেভাবে সবাই একসঙ্গে ছিলেন, পরবর্তী সংস্কার ও নির্বাচনের জন্যও সবাইকে একসঙ্গে নিয়েই সমাধান করতে হবে। অর্থাৎ, কার্যকর সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করা। আর বিরাজনীতিকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশে কখনো কোনো সমস্যার সমাধান হয়নি। মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর বিজয়নগরে এবি পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে মজিবুর রহমান মঞ্জু এসব কথা বলেন। তার আরও অভিমত, এ মুহূর্তে সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ দুটি-একটি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং সাধারণ মানুষের কাছে একটা আশা ও সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখা। আরেকটি হলো-আন্দোলনে সবাই যেভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিল, প্রাথমিক বিজয়ের পর তাদের মধ্যে অনৈক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাজনৈতিক দল, ছাত্র-জনতার সেই ঐতিহাসিক ঐক্যকে সুসংহত করা ও ধরে রাখা। সাক্ষাৎকারে সরকারের দুই মাসের কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন, দেশের চলমান পরিস্থিতি, রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচন, ছাত্রদের দল গঠন, লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ, নিজ দলের কার্যক্রম, ভারতে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতিসহ সমসাময়িক নানা ইস্যুতে খোলামেলা কথা বলেন তিনি।
যুগান্তর : অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই মাস পূর্ণ হলো। সরকারের কর্মকাণ্ডে আপনার মূল্যায়ন কী।
মঞ্জু : প্রথমদিকে সরকার একটু বিপর্যস্ত ছিল। অভিজ্ঞতার অভাবে অনেক কাজ গুছিয়ে উঠতে পারেনি। দিন যত যাচ্ছে, ধীরে ধীরে তাদের উপলব্ধি বাড়ছে এবং নিজেদের গুছিয়ে নেবে-এটাই আমাদের সঙ্গে আলাপে মনে হয়েছে। আমাদের নানা আলোচনা, পর্যালোচনা ও সমালোচনার কারণে তারা তাদের সঠিক কাজের লাইনটা খুঁজে পাবে আশা করি। কাজগুলোও তারা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে।
যুগান্তর : প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ছয় দফা পর্যবেক্ষণ এবং ১১ দফা প্রস্তাব পেশ করেছে এবি পার্টি। এ বিষয়ে সরকারের মনোভাব কী মনে হয়েছে?
মঞ্জু : ইতিবাচক মনে হয়েছে। অনেক কিছুর সঙ্গে একমতও হয়েছে। তবে তাদের কিছু সীমাবদ্ধতার কথাও তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে প্রশাসন ও পুলিশে অচলাবস্থা নিয়ে তারা ভাবছেন। আশাবাদী, এসব বিষয় তারা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন বা নেবেন।
যুগান্তর : রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্য দিয়ে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি রাজনৈতিক দলগুলোর। এজন্য যৌক্তিক সময় দেবে। সেই যৌক্তিক সময় কতদিন হতে পারে?
মঞ্জু : আমরা যৌক্তিক সময় হিসাবে একটি প্রস্তাব দিয়েছি দেড় থেকে দুই বছর। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সংস্কার কমিশনের যে প্রস্তাবগুলো আসবে, সেগুলো সবার কাছে যদি গ্রহণযোগ্য হয়, তখন তাদের কাছে দুটি বিকল্প থাকবে। একটি হচ্ছে প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন করা এবং বাস্তবায়নের পর নির্বাচনে যাওয়া। আরেকটি হচ্ছে প্রস্তাবগুলো এভাবে রেখেই নির্বাচনে যাওয়া। এটা আমার আছে যুক্তিযুক্ত প্রস্তাব মনে হয়েছে। আগে সংস্কারের প্রস্তাবগুলো রেডি হোক, সবাই মিলে সেই প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত বাছাই করার পর নির্বাচনের সময়টা তখন ঠিক করা যাবে। আশা করি, এতে সব রাজনৈতিক দল একমত হবে।
যুগান্তর : সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছেন। সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলছেন-এমন বক্তব্য ভাইরাল হচ্ছে। এটিকে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল উসকানি দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা বলে অভিযোগ করেছেন। আপনি কী মনে করছেন।
মঞ্জু : এটা তো শেখ হাসিনার একটা বৈশিষ্ট্য। উনি উসকানিমূলক কথাবার্তা বলেন। এটা উনি আগেও করেছেন, এখনো করছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। সুতরাং আমাদের বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এটিকে আমরা অতীতেও মোকাবিলা করেছি, ভবিষ্যতেও মোকাবিলা করতে হবে।
যুগান্তর : ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। আপনি কি মনে করেন বিএনপি, আপনারাসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘ ত্যাগের পটভূমিতেই ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থান।
মঞ্জু : হ্যাঁ। একটি আন্দোলনের চূড়ান্ত সফলতার অনেক স্তর থাকে। প্রথমত, আমরা যে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলনে গিয়েছিলাম, আওয়ামী লীগ সেটাকে নৃশংসভাবে দমন করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো সহিংস আন্দোলনে জড়ায়নি। কিন্তু একটা কথা আমাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল-বাংলাদেশে সহিংস আন্দোলন ছাড়া কোনো বিজয় আসেনি। কিন্তু চূড়ান্তভাবে দেখলাম, ছাত্ররা যখন রাজপথে নেমেছে, সরকারের উসকানিতে তখন সহিংস আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। সহিংসতার একটা বীভৎস রূপ, পুলিশের বীভৎস হত্যাযজ্ঞ-সবকিছুর পরিণতিতে রাস্তায় ছাত্র-জনতা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে নেমেছে এবং সরকারের পতন হয়েছে। সুতরাং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এটা একটা আন্দোলনের ধারাবাহিকতা। সবারই এখানে চেষ্টা ছিল। এমনকি সেনাবাহিনীরও একটা ভূমিকা ছিল। সুতরাং এ কৃতিত্ব সবার। কিন্তু এর চূড়ান্ত নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্ররা।
যুগান্তর : অভ্যুত্থানের পর এবি পার্টি এখন আগের চেয়ে বেশি লাইমলাইটে। এর পেছনে কারণ কী?
মঞ্জু : লাইমলাইটে আমি সেভাবে মনে করি না। দল হিসাবে বারবার বলার চেষ্টা করেছি, একটা অধিকারভিত্তিক রাজনীতিই হচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র ঐক্যের সূত্র। মতবাদ বা ধর্মীয় বিভেদ দিয়ে কখনো মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা যাবে না। একটা চরম স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে অধিকারের দাবি নিয়েই জাতীয় ঐক্য গড়তে হবে-এটাই ছিল এবি পার্টির রাজনীতির মূলকথা। এবারের আন্দোলনে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। যে কারণে আমাদের ভয়েজটা গুরুত্ব পেয়েছে, নেতাদের কথাটাকে মানুষ সঠিক হিসাবে গ্রহণ করেছে। সীমিত সামর্থ্যে এই আন্দোলনে সর্বাত্বক ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছি। নির্যাতিত হয়েছি, কারাবরণ করেছি এবং ছাত্রদের সর্বাত্বকভাবে সহযোগিতার জন্য চেষ্টা করেছি। এটির স্বীকৃতি এবং মানুষের কাছ থেকে এটির সাধুবাদ পেয়েছি, এটাই আমাদের বড় অর্জন।
যুগান্তর : বিরাজনীতিকরণের কথা আসছে। ‘আবার মাইনাস টু ফর্মুলা দেখতে চাই না’-এমন বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন।
মঞ্জু : উনি (বিএনপি মহাসচিব) যেভাবে বলেছেন আমার কাছে মনে হয়েছে, তার কথাকে সঠিকভাবে চিত্রায়িত করা হয়নি। প্রথমদিকে আমাদের উপদেষ্টারা রাজনৈতিক দলগুলোকে বাদ দিয়ে যেভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছিলেন, তিনি (বিএনপি মহাসচিব) সে ব্যাপারে তাদের ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন। আমি মনে করি, আন্দোলনে আমরা যেভাবে সবাই একসঙ্গে ছিলাম, পরবর্তী সংস্কার ও নির্বাচনের জন্যও সবাইকে একসঙ্গে নিয়েই সমাধান করতে হবে। বিরাজনীতিকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশে কখনো সমস্যার সমাধান হয়নি।
যুগান্তর : সম্প্রতি লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ হয়েছে। সেখানে নিশ্চয়ই রাজনৈতিক আলাপও হয়েছে।
মঞ্জু : তিনটি সুস্পষ্ট বিষয়ে আমরা কথা বলেছি। এবি পার্টি গঠন ও পার্টির রাজনৈতিক প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি (তারেক রহমান) অনেক বিষয় জানতে চেয়েছেন। বর্তমান রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিয়ে কার্যকর আলোচনা হয়েছে। আগামী দিনে বিএনপির যেই সংস্কার ভাবনা এবং রাষ্ট্র বাংলাদেশকে যে নতুনভাবে গড়ে তোলার অভিপ্রায়, তার কথায় আমার কাছে সেটা প্রতিফলন ঘটেছে। আমি মনে করেছি, উনি বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন করে ভাবছেন। বাংলাদেশের নেতৃত্ব বহনের জন্য মানসিকভাবে তাকে বেশ দৃঢ় মনে হয়েছে। সার্বিকভাবেই আলোচনা আমার বিবেচনায় বেশ ফলপ্রসূ বলে মনে হয়েছে।
যুগান্তর : ছাত্র-জনতা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত বড় মাপের চিহ্নিত অপরাধীরা এখনো অধরা। এ ব্যাপারে মন্তব্য কী?
মঞ্জু : মূলত আইনশৃঙ্খলার প্রধান কর্তৃপক্ষ হচ্ছে পুলিশ। পুলিশের মনোবল একেবারেই ভেঙে গেছে। যে কারণে গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের তৎপরতায় ভাটা থাকার কারণেই গণহত্যাকারী বা স্বৈরশাসকের দোসররা এক ধরনের সুবিধা পাচ্ছে। অনেকে আত্মগোপনে আছে। আশা করি, এ বিষয়টি ধীরে ধীরে কেটে যাবে এবং সরকার এ ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি দেবে।
যুগান্তর : আপনারা বলছেন, ফ্যাসিবাদ সরকারের সঙ্গে জড়িত প্রশাসনের কর্মকর্তারা এখনো বহাল আছে। দ্রুত অপসারণের কথা বলেছেন। সরকার তা কি করছে বলে মনে হয়?
মঞ্জু : এক্ষেত্রে সরকারের কিছু দ্বিধা এবং ধীরগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। সেজন্য আমরা স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে আরও গতিশীল করার পরামর্শ দিয়েছি। এ ব্যাপারে সরকারের সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
যুগান্তর : আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি আসছে। এ দাবির সঙ্গে আপনার দলের অবস্থান কী?
মঞ্জু : আওয়ামী লীগ একটা রাজনৈতিক দল। কিন্তু বাংলাদেশের গণতন্ত্র হত্যা, সংবিধানকে ভূলুণ্ঠিত করা, মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারকে ধূলিসাৎ করা এবং দেশকে একটি ফ্যাসিবাদী স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার মূল হোতা আওয়ামী লীগ। একদিকে আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক রাজনীতি করার অধিকার, আরেকদিকে দেশ ধ্বংসের কারণে তার বিচারের প্রশ্ন। এ দুটি এখন ছাত্র-জনতার একটি প্রধান দাবি। আমরা মনে করি, যৌক্তিক বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির অধিকারের বিষয়টি সমাধান করা উচিত।
যুগান্তর : বিচারের আগে ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসনের সুযোগ নেই বলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলছেন।
মঞ্জু : এ বিষয়ে ছাত্রদের মতামতের সঙ্গে আমরা একমত।
যুগান্তর : গুঞ্জন রয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ দিয়ে একটি নতুন দল গঠনের। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
মঞ্জু : রাজনীতির পথটা অত্যন্ত কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং। তারা যদি বাস্তবতা চ্যালেঞ্জ নিয়ে এ ধরনের কোন উদ্যোগ নেয়, আমরা সেটিকে সাধুবাদ জানাব।
যুগান্তর : কোনো জোটে নাকি এককভাবে নির্বাচন করবে এবি পার্টি। সেক্ষেত্রে বিএনপির সঙ্গে জোট গঠনের কোনো সম্ভাবনা আছে কি না।
মঞ্জু : বর্তমান পরিস্থিতিতে এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছি। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে কোনো জোটের কাছ থেকে প্রস্তাব পেলে বা নিজেরাও একটা জোট গঠনের সুযোগ থাকলে সেটিকে রাজনৈতিক কৌশল হিসাবেই বিবেচনায় নেব।