Logo
Logo
×

অন্যান্য

শ্বশুরবাড়ি গোপালগঞ্জের দাপট ভূমি রাজস্ব পরিচালক রেজাউলের

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:১৮ এএম

শ্বশুরবাড়ি গোপালগঞ্জের দাপট ভূমি রাজস্ব পরিচালক রেজাউলের

সারা দেশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধিগ্রহণকৃত প্রায় ৩৫ হাজার একর জমির পসরা সাজিয়ে বসেছেন ভূমি রাজস্ব পরিচালক মো. রেজাউল করিম। এখান থেকে শত শত একর জমি নামে-বেনামে, লিখিত ও মৌখিকভাবে লিজ দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। কী পরিমাণ জমি বরাদ্দ বা লিজ দেওয়া হয়েছে, অবশিষ্ট জমির পরিমাণই বা কত-এসবের কোনো হিসাব মিলছে না। সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী এবং গোপালগঞ্জের নাম ব্যবহার করে কর্মস্থলে নিজের ক্ষমতার বলয় প্রসারিত করেছেন। এভাবেই ৩৫ হাজার একর জমির অলিখিত মালিক সেজে বসেন।

চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠিত এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টেই আছে পাউবোর একশ একর জমি। একই প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে ৪০ একর জমির ৫ বছরের জন্য লিজ নবায়নের মাধ্যমে পকেটে তুলেছেন মোটা অঙ্কের অর্থ। এভাবে প্রতিমাসে পাউবোর অধিগ্রহণকৃত জমি লিখিত ও মৌখিক লিজের নামে লাখ লাখ টাকা মাসোহারা আদায় করে এসেছেন তিনি।

অধিগ্রহণকৃত জমি লিজ বা বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করতেন না রেজাউল। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবে নিজেকে ক্ষমতাবান বলে জাহির করায় এতদিন কেউ কিছু বলার সাহস পাননি। কিন্তু ৫ আগস্টের পর থেকে তার অপকর্মের খতিয়ান প্রকাশ্যে আসা শুরু করেছে। ৫ বছরে তিনি এ অবৈধ আয়ে শুধু বনানীতেই কিনেছেন বিলাসবহুল দুটি ফ্ল্যাট। লাখ লাখ টাকার এফডিআরসহ দামি গাড়ি এবং নিজ গ্রামে দৃষ্টিনন্দন বাড়িও করেছেন। যুগান্তরের দীর্ঘ অনুসন্ধানে এ কর্মকর্তার দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়।

জানা যায়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর ক্ষমতা ব্যবহার করে পাউবো থেকে একটি দপ্তরাদেশ জারি করে দুর্নীতির লাইসেন্স নিজের কবজায় নেন এই রেজাউল। তিনি পাউবোর অধিগ্রহণকৃত অব্যবহৃত জমি ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে সারা দেশের প্রধান প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলীর ক্ষমতা খর্ব করে অফিস আদেশ জারি করান।

ইজারা বিষয়ে যেসব আবেদন জেলা পর্যায়ে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা, সেগুলোর নথি ভূমি ও রাজস্ব পরিদপ্তরে পাঠানোর দপ্তরাদেশ জারি করান। এভাবেই রেজাউল করিম পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূমি ও রাজস্ব পরিদপ্তরের পরিচালক হয়ে ৩৫ হাজার একর অব্যবহৃত জমির প্রচ্ছন্ন মালিক সেজে বসেন। এতে আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়ার মতো নিজের ও পরিবারের নামে অবৈধ সম্পদের পরিমাণ বাড়াতে থাকে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, মো. রেজাউল করি পাউবোর বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহসভাপতির দায়িত্ব নিয়ে যেন দুর্নীতি করার সনদ হাতে পান। পাউবোর সিনিয়র কয়েকজনকে ডিঙ্গিয়ে উপপরিচালক থেকে ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ ভূমি ও রাজস্ব পরিচালক পদে পদোন্নতি আদায় করেন। এরপর তার লাগাম টেনে ধরা যায়নি। পরে ঘুস-দুর্নীতির অভিযোগে ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি পাউবোর ভূমি ও রাজস্ব পরিদপ্তর থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে শ্বশুরবাড়ি গোপালগঞ্জের ক্ষমতায় দুই মাসের মাথায় ২০২০ সালের ১৯ মার্চ আবারও তিনি ভূমি-রাজস্ব পরিদপ্তরে পোস্টিং নিয়ে ফিরে আসেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী গাজী হাফিজুর রহমান লিকুর অবৈধ হস্তক্ষেপে পাউবোতে এক মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হন। এ কর্মকর্তা ঢাকা সিটিসহ সারা দেশে আওয়ামীপন্থি ‘নীল দল’-এর একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। এ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পাউবোর অধিগ্রহণকৃত ৩৫ হাজার একরের মধ্যে অন্তত ২০ হাজার একর জমি নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে লিখিত ও মৌখিক লিজ দিয়েছেন। ঘুস, দুর্নীতি করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন এ কর্মকর্তা।

আয়বহির্ভূত সম্পদের চিত্র : রেজাউল করিম বাসা ভাড়া ও অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বাদ দিয়ে প্রতিমাসে বেতন পান ৫৮ হাজার টাকা। অথচ ২০১৯ সালে ভূমি ও রাজস্ব পরিদপ্তরে যোগদানের পর তার সম্পদের পরিমাণ বাড়তে থাকে। গত কয়েক বছরে তিনি কোটি কোটি টাকার স্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছেন। শুধু বনানীতেই তিনি আলিশান দুটি ফ্ল্যাট কিনে ভাড়া দিয়েছেন। ফ্ল্যাট ২টির বাজারমূল্য অন্তত ৮ কোটি টাকা। বনানী আই ব্লকে ১নং রোডে ২১নং প্লটে আধুনিক ডিজাইনে নির্মিত ভবনে তার বি-৩নং ফ্ল্যাট রয়েছে। ২০২৩ সালের ১৭ জুলাই ৫৯০৮নং দলিলে ২৭১৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের মালিক রেজাউল করিম। স্ত্রী হোসনে আরা বেগমের নামে আরেকটি ফ্ল্যাট কিনেছেন বনানীর কে-ব্লকে। ২০২১ সালে ১০ অক্টোবর ১৫৬০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটটি রেজিস্ট্রি হয় গ্যারেজসহ। ফ্ল্যাটের ঠিকানা: ব্লক-কে, রোড-২০, প্লট-৩০, ফ্লাট-বি/৪। গুলশান সাবরেজিস্ট্রি অফিসের দলিল নং ৬৮১২। এছাড়াও ঢাকার উত্তরায় রয়েছে ২৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট। ঠিকানা: বাড়ি নং-২১, রোড নং-০২, সেক্টর-১৩, উত্তরা মডেল টাউন। মিরপুরে ১টি ১৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, উত্তরায় ৫ কাঠার প্লট এবং কক্সবাজারে স্যুট ক্রয় করেন। জামালপুর সদরের বেলটিয়ায় ডুপ্লেক্স বাড়ি, লেটেস্ট মডেলের একাধিক গাড়ি আছে তার। এর মধ্যে যুগান্তরের তথ্যানুসন্ধানে ঢাকায় এলিয়ন গাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়াও ফাইন্যান্স কোম্পানি আইপিডিসি, জাতীয় সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার নামে, স্ত্রী ও সন্তানদের নামে-বেনামে রয়েছে কোটি কোটি টাকার এফডিআর, সঞ্চয়পত্র।

জমি লিজের চিত্র : ঢাকা উত্তরার আব্দুল্লাহপুরে পাউবোর ১০ একর জমির ওপর মাছবাজার, ৮ একর জমির ওপর সবজি বাজার, শতশত একর জমিতে বালুমহাল, দোকান ভিটি, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এসব লিজের কোনোটি কাগজে, কোনোটি আবার মৌখিক নির্দেশনায় চলছে বছরের পর বছর। আওয়ামী লীগের নামে নীল দল করে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা লোপাটের সিঁড়ি তৈরি করেন রেজাউল। ঢাকার মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে ৫০ একরের বেশি জমি বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। চাঁদপুরের মেঘনা ধনাগোদা এলাকায় মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পানি উন্নয়ন বিভাগের ৩০ একর জমি আলোছায়া পর্যটনকেন্দ্রকে লিজ না দিয়ে মৌখিকভাবে জমি বুঝিয়ে দিয়েছেন। সরকারি রাজস্ব আদায় না করে নিজের পকেটে নিচ্ছেন টাকা। মতলব উত্তর-চাঁদপুরের মোহনপুর পর্যটনকেন্দ্রকেও একইভাবে পাউবোর জমি দিয়ে ঘুস বাণিজ্য করেছেন। ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩০/৪০ একর জমি নিজস্ব সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দিয়েছেন রেজাউল। এভাবে সারা দেশে তার একক আধিপত্যের নৈরাজ্য গড়ে তুলেছেন। এছাড়াও চট্টগ্রামের এস আলমের নামে ৪০ একর জমির লিজ নবায়ন করে বিপুল টাকা ঘুস নিয়েছেন। সিলেটের মৌলভীবাজারে ড্রিমল্যান্ড পর্যটন কেন্দ্রকে ৪০ একর জমি লিজ দিয়ে নগদ অর্থ গুনে নিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাউবোর একজন সিবিএ নেতা যুগান্তরকে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৬৪ জেলার সব বিভাগে রেজাউল করিমের ইজারা সংক্রান্ত দালাল রয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তিনি পাউবোর সব জমি গিলে ফেলেছেন। তাকে গ্রেফতার করে দুর্নীতির তদন্ত করতে হবে।

পাউবোর আরেক কর্মকর্তা বলেন, পাউবোর পূর্ব রিজিয়নের উপপরিচালক পদে থাকাকালীন উত্তরায় মুনসুর আলী মেডিকেল কলেজের পাশে প্রায় শতকোটি টাকা দামের জমির তদন্ত নথি গায়েব করেন। সেখানে একটি চক্র পাউবোর জমি জাল দলিল করে দখল করেছিল। ভূমিদস্যুদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে সেই তদন্ত প্রতিবেদনই গায়েব করেন রেজাউল। অদ্যাবধি জমি জাল-জালিয়াতির ওই নথি আলোর মুখ দেখেনি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া পানি উন্নয়ন বিভাগের মাত্র ১৫ শতাংশ কৃষিজমি লিজ দিয়ে সরকারের রাজস্ব খাতে ২ হাজার টাকা জমা করা হয়। এ জমি থেকে ব্যক্তিগতভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা। রাজবাড়ীর একটি জমি লিজ দিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।

কম্পিউটার চুরি করে ধরা : সম্প্রতি কম্পিউটার চুরি করেও ধরা পড়েন রেজাউল। এ বিষয়ে জানা যায়, পাউবোর একটি প্রকল্প থেকে ভূমি ও রাজস্ব পরিদপ্তরের কাজের স্বার্থে দামি একটি কম্পিউটার দেওয়া হয়। তিনি নিজেই সেটি রিসিভ করে দপ্তরে না এনে বাসায় নিয়ে যান। পানি ভবনের প্রধান ফটকে গোয়েন্দা পরিদপ্তরের আনসারদের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে ধরা পড়ে। তাকে ঘিরে এরকম ছোট ছোট চুরির অভিযোগ থাকলেও এতদিন কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করেননি। তার যন্ত্রণায় চাকরি ছেড়ে আমেরিকায় চলে যান পরিচালক (অ্যাকাউন্টস) সানাউল হক। পাউবোর বনানী স্টাফ কোয়ার্টারে কল্যাণ পরিপ্তরের পরিচালক আব্দুর রশিদের সঙ্গে নারিকেল নিয়েও মারামারি করেন।

ক্ষমতার নমুনা : ভূমি ও রাজস্ব পরিদপ্তরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আছমা সুলতানা পরিচালক রেজাউল করিমের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত চাওয়ায় তাকে ফরিদপুরে বদলি করেন পাউবোর মহাপরিচালক। সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা তন্দ্রা বালা তার দেড় বছরের শিশুকন্যা এবং স্বামীসহ দুইজনকে ফরিদপুর থেকে ঢাকায় বদলি করা হয়েছে, যা নারী কর্মকর্তার প্রতি অমানবিক অবিচার করা হয়েছে বলে মনে করেন পাউবোর কর্মকর্তারা।

বক্তব্য : এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মুহাম্মদ আমিরুল হক ভুঞা মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে আমিও অনেক অভিযোগ পেয়েছি। এর আগেও তাকে ভূমি রাজস্ব পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল বলে শুনেছি। কিন্তু নানান কারণে তা সম্ভব হয়নি বলে আমাকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে রেজাউল করিমকে পাউবোর কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে পাউবোর ভূমি রাজস্ব কর্মকর্তা রেজাউল করিম মঙ্গলবার বলেন, ‘অভিযোগ থাকতেই পারে। কিন্তু ভূমি রাজস্ব কর্মকর্তার পাউবোর জমি লিজ দেওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে এ সংক্রান্ত কমিটি জমি লিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার বিষয়ে রেজাউল করিম বলেন, মিরপুরে আমার একটি ফ্ল্যাট ছাড়া কোনো সম্পদ নেই। কেউ দেখাতে পারবে না। বনানীর ফ্ল্যাট সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, হ্যাঁ, বনানীতে স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট আছে। নিজের নামে থাকা বনানীর অপর ফ্ল্যাটের কথা তিনি অস্বীকার করেন। গাড়ি আছে স্ত্রীর নামে, পরে তাও স্বীকার করেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম