‘মাতৃহারা সন্তান জানে পদ্মা সেতু কী, কেন?’
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৪, ০৯:১২ পিএম
বিশ্বব্যাংকসহ চারটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ঋণে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প চূড়ান্ত করে আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগে প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সংস্থাগুলো। বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে প্রমাণও হয় যে, এই প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি।এরপর বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে ফিরে আসার আগ্রহ দেখালেও বঙ্গবন্ধুকন্যা সিদ্ধান্ত নেন নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করবেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৪ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে সেতুর কাজ শুরু হয়।
বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু দিয়ে সড়কপথে বাংলাদেশে যোগাযোগের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। এরপর ২০২৩ সালে চালু করা হয় রেলপথ।
আজ (৫ জুলাই) ছিল পদ্মা সেতু প্রকল্পের সমাপনী দিন। এ উপলক্ষ্যে বিকালে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে সুধী সমাবেশের আয়োজন করা হয়।অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘পদ্মা সেতু’ বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হার না মানা মানসিকতা, কমিটমেন্ট আর নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসের অনন্য প্রতীক।
এ সময় পদ্মা সেতু কিভাবে মানুষের স্বপ্নে এবং সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত সেতু তারও ব্যাখ্যা দেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘মুমূর্ষু মাকে নিয়ে যে ছেলেটি ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছিল ওপারে। ফেরি নেই, লঞ্চ নেই, স্প্রিড বোট নেই। পদ্মার তীব্র স্রোত। দিন যায়, রাত গড়ায়, সকাল আসে। ওই পদ্মা পাড়েই মা ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে। সেই মাতৃহারা সন্তান জানে পদ্মা সেতু কী এবং কেন? লঞ্চডুবি, মায়ের বুকে সেদিন বাচ্চা। প্রবল স্রোত। স্রোতের টানে মায়ের আচল থেকে ভেসে গেল অবুঝ শিশু। সে সন্তানহারা হলো। মা জানে পদ্মা সেতু কী এবং কেন? বাবার জানাজায় অংশ নিতে মাওয়া প্রান্তে ছেলে বসে আছে। লঞ্চ নেই, ফেরী নেই, স্প্রিড বোট নেই। জানাজায় ছেলে অংশ নিতে পারেনি। এই জানাজায় অংশগ্রহণ করতে এসে পদ্মা পাড়ে যে বাবার সন্তান তার জানাজায় অংশ নিতে পারল না, সে জানে পদ্মা সেতু কী এবং কেন?’
পদ্মা সেতুর নির্মাণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন সেটি উল্লেখ করে সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘কমিটমেন্ট কাকে বলে...এই পদ্মার আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা...মনে আছে? ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। এর আগের দিন ২৯ সেপ্টেম্বর পদ্মা এলাকায় ঘর কুয়াশা। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। প্রথম স্প্যান পিলারের ওপর বসবে। নেত্রী তখন ওয়াশিংটনে। নেত্রীকে ফোন করলাম। তৎকালীন সচিব আনোয়ার সাহেব আমার পাশে। নেত্রীকে বললাম, প্রথম যে স্প্যানটা বসবে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। আপনি ফিরে আসলে আপনার উপস্থিতে প্রথম স্প্যান বসাব। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ওয়াশিংটন থেকে বললেন, আমার জন্য পদ্মা সেতুর কাজ এক মিনিটও অপেক্ষা করা যাবে না। এটা হলো কমিটমেন্ট। এই কমিটমেন্টের সোনালী ফসল এই পদ্মা সেতু।’
পদ্মা সেতু নির্মাণ হাজারো চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা ছিল- এমনই এক ঘটনা বলতে গিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এক মধ্যরাতে কনট্রাক্টরদের মাথায় হাত। ওইদিকে জাজিরা ভাঙছে। এদিকে লৌহজং ভাঙছে। এরই মধ্যে কনট্রাক্টরদের ইয়ার্ড, যন্ত্রপাতি হুমকির মুখে। পানির স্রোত ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করলাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফোন ধরলেন। আমার দু’চোখ ভরে তখন পানি। আমি অশ্রু সংবরণ করতে পারছিলাম না। একই অবস্থা খন্দকার আনোয়ারের, একই সঙ্গে পিডি শফিকেরও। নেত্রী সঙ্গে সঙ্গে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন এবং এখানে যত দরকার জিও ব্যাগ সরবরাহ করতে বললেন। এই হচ্ছে শেখ হাসিনা। এই হচ্ছে তার বিচক্ষণ, দূরদর্শী, সাহসী নেতৃত্ব। আজ স্মৃতিগুলো বারবার মনে পড়ছে।’
পদ্মা সেতুর নামকরণের ক্ষেত্রে এর স্বপ্নদ্রষ্টা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে করার জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে দাবি করা হলেও বঙ্গবন্ধুকন্যা নিজের নামে এই সেতু করতে না করে দেন। সেই কথা তুলে ধরে সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘সংসদে দাবি উঠেছিল। সারা বাংলাদেশে বহু মানুষ দাবি তুলেছিল। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু হবে পদ্মা নদীর নামে। আমার নাম ব্যবহার করা যাবে না।’
এ সময় ওবায়দুল কাদের প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘পদ্মা সেতুর সঙ্গে আপনার নাম মিশে গেছে। যতদিন এই বাংলায় পদ্মা সেতু থাকবে পদ্মা নদীর ওপরে, ততদিন শেখ হাসিনার নামও উচ্চারিত হবে স্বগৌরবে। আপনার সাহস, আপনার দূরদর্শিতা আমাদের বিশাল সম্পদ। সংকটে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সাহস দেয়।’
ওবায়দুল কাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন- সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্য দেন সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মনজুর হোসেন। প্রকল্পের বিস্তারিত তুলে ধরেন পদ্মা বহুমুখী সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই পদ্মা সেতুর থিম সং প্রচার করা হয়। এ ছাড়া পদ্মা সেতুর ওপর একটি প্রামাণ্য চিত্র দেখানো হয়। সুধী সমাবেশে সেতুমন্ত্রী ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা স্মারক ও পদ্মা সেতুর একটি আউটলুক উপহার দেওয়া হয়।