ট্রেন লাইনচ্যুত-দুর্ঘটনা: ঈদযাত্রায় শিডিউল বিপর্যের শঙ্কা
শিপন হাবীব
প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৪, ১২:৪২ এএম
এবারও ঈদযাত্রায় চলমান ট্রেনের সঙ্গে ১৬টি স্পেশাল ট্রেন সংযুক্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন ট্রেনে যুক্ত করা হয়েছে ৭২টি কোচ। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহণ এবং কোচ সংযোজনে ট্রেন লাইনচ্যুত ও দুর্ঘটনার শঙ্কা থাকে। অপরদিকে ট্রেন চালক ও গার্ড স্বল্পতায় স্পেশাল ট্রেনও নির্ধারিত চালক-গার্ড দ্বারা পরিচালনা করা হবে। এতে একজন চালক-গার্ড ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টা ট্রেন চালাতে হবে। অতিরিক্ত চাপ দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই। কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে বা লম্বা সময় ধীরগতিতে ট্রেন চললে শিডিউল বিপর্যয় ঘটতে পারে। যা ঘরে ফেরা যাত্রীদের চরম দুর্ভোগে ফেলবে।
ঈদযাত্রার আগে ট্রেন দুর্ঘটনা নতুনভাবে শঙ্কা সৃষ্টি করছে। মঙ্গলবার রাতে ঈশ্বরদীতে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে দায়িত্বে অবহেলায় সহকারী স্টেশন মাস্টারসহ ট্রেনের দুই চালককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এর আগে ১৭ মার্চ কুমিল্লার লাঙ্গলকোটে বিজয় এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় ইঞ্জিনসহ ৯টি বগি লাইনচ্যুত হয়। মঙ্গলবার ১৩টি ট্রেন ৩০ মিনিট থেকে পৌনে ৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্বে চলেছে। বুধবার মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস আড়াই ঘণ্টা বিলম্বে কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে গেছে। এছাড়া বনলতা, যমুনা, চট্টলা, সিল্কসিটিসহ ৯টি আন্তঃনগর ট্রেন ১৫ মিনিট থেকে পৌনে ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্বে চলাচল করেছে।
রেলপথে ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রেলপথ সচিব ডা. হুমায়ুন কবির। তিনি যুগান্তরকে জানান, টিকিট কালোবাজারি বন্ধ হয়ে আসছে। প্রথমবারের টিকিট ওপিটির মাধ্যমে কাটতে হচ্ছে। টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত এমন অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। টিকিটধারী যাত্রীদের ভ্রমণ নিশ্চিত করতে স্টেশন এবং ট্রেনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং রেলসংশ্লিষ্টরা অবস্থান করবেন। লাইনচ্যুত-দুর্ঘটনা এবং শিডিউল বিপর্যয় যাতে না হয়- সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তারপরও লাইনচ্যুত-দুর্ঘটনা ঘটলেও বিভিন্ন সেকশনে অতিরিক্ত ইঞ্জিন-কোচ এবং লোকবল প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
বুধবার সরেজমিন কমলাপুর স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে স্টেশন চত্বর থেকে শুরু করে প্ল্যাটফর্ম পর্যন্ত ঈদ বার্তায় সাজানো হচ্ছে। টিকিটধারী যাত্রীরা ৪টি সারি দিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করবেন। স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সরওয়ার যুগান্তরকে বলেন, কাউন্টার থেকে ঈদযাত্রার কোনো টিকিট দেওয়া হচ্ছে না। চলতি লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেনের টিকিট কাউন্টার থেকে বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, ঈদযাত্রায় যাতে শিডিউল বিপর্যয় না হয় সেজন্য আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।
ঈদযাত্রা বিষয়ে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে মহাব্যবস্থাপক (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার। তিনি বলেন, মন্ত্রীর (রেলপথমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম) নির্দেশনায় তার অঞ্চলের পুরো রেলপথ পরির্দশন করা হচ্ছে। আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সবাই মাঠে। একই সঙ্গে ট্রেনচালক ও গার্ডদের ত্বরান্বিত করতে বৈঠক করা হচ্ছে। সর্বোচ্চ নির্দেশনা প্রদান করা হচ্ছে-সিগন্যাল গ্রিন ছাড়া কোনো অবস্থাতেই ট্রেন চালানো যাবে না। গ্রিন সিগন্যাল ও স্টেশন মাস্টারের অনুমতি না পেয়ে অনুমানভিত্তিক ট্রেন চালানো যাবে না। ঈদযাত্রা এবং ঈদ ফিরতি পর্যন্ত আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মাঠপর্যায়ে অবস্থান করবেন।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. নাজমুল হোসেন জানান, এ অঞ্চলের কর্মকর্তারাও মাঠে আছেন। ইঞ্জিন-কোচ, পাওয়ারকার নিয়মিত পরীক্ষা করা হচ্ছে। আমরা জানি ঈদযাত্রায় কিছু কিছু ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রী ভ্রমণ করে। সব মিলিয়ে সতর্কাবস্থানে থাকব আমরা। বিভিন্ন সেকশনে অতিরিক্ত ইঞ্জিন-কোচ রাখা হচ্ছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে উদ্ধারকারী ট্রেন ও লোকবল।
এক ট্রেনচালক জানান, ঈদের সময় প্রায় প্রতিটি ট্রেনেই নির্ধারিত যাত্রীর চেয়ে প্রায় ২-৩ গুণ বেশি যাত্রী চলাচল করে। ওই সময় কোনো ট্রেন লাইনচ্যুত হলে সেই দায়ও ট্রেনচালক, গার্ড এবং সংশ্লিষ্টদের নিতে হয়। কিছু ট্রেনে মৌমাছির মতো যাত্রীরা উঠে পড়েন। ইঞ্জিনের দুপাশেও যাত্রীরা বসে পড়েন। ফলে প্রায় সব রুটেই ট্রেন চালাতে গেলে নাভিশ্বাস ওঠে সংশ্লিষ্টদের। চালক ও গার্ডস্বল্পতা রয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। তবু ঈদযাত্রায় শুধু যাত্রীদের কল্যাণে অতিরিক্ত ১৬টি ট্রেন চলবে।
প্রতিবছর ঈদে গ্রামের বাড়িতে যান সামসুন্নার হীরা। তিনি বললেন, আগে ট্রেন অনেক বেশি নিরাপদ ছিল। কিন্তু এখন রাত কিংবা দিনের ট্রেনে নিরাপত্তা অনেক ঢিলেঢালা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও চোখে পড়ে না। রাতে একা শৌচালয়ে যেতেও ভয় লাগে। তিনি বলেন, ‘টিকিট যার ভ্রমণ তার’ এমন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ট্রেনের ভেতর টিকিটও যথাযথ চেকিং করা হয় না। টিকিট ভেন্ডিং মেশিনও চোখে পড়ে না। তবে রেলযাত্রীদের অধিকাংশের একটাই প্রশ্ন, রেলের সার্বিক পরিকাঠামোর সমস্যার সমাধান হবে তো। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঈদযাত্রায় শিডিউল অনুযায়ী ট্রেন চলবে তো?
এ প্রসঙ্গে রেলওয়ে মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী যুগান্তরকে জানান, যাত্রীদের সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে অবস্থান করবেন। নির্ধারিত স্থানে উদ্ধারকারী ট্রেনসহ অতিরিক্ত ইঞ্জিন-কোচ রাখা হয়েছে। তবে আমাদের অনুরোধ, বিনা টিকিটি রোধে সাধারণ যাত্রীদেরও করণীয় রয়েছে। অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে ট্রেন চলবে-কিছুটা ঝুঁকি থাকে। আমরা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। যাত্রীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ট্রেন চালানোর সর্বোচ্চ কৌশল ব্যবহার করবে রেল।