অনিয়ম-কারচুপি ও ভোট জালিয়াতির অভিযোগ
ঢাকা-১ আসনে পুনর্নির্বাচন দাবি
নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনের কাছে বারবার অভিযোগ করেও সাড়া মেলেনি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০১:১৯ এএম
নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে রোববার সাংবাদিকদের সামনে কথা বলছেন ঢাকা-১ আসনে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম- যুগান্তর
ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, কেন্দ্র দখল, লাঙ্গলের এজেন্টদের বের করে দেওয়া, বাধা দেওয়া এবং জাল ভোটের অভিযোগে ঢাকা-১ আসনে (দোহার-নবাবগঞ্জ) পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন লাঙ্গলের প্রার্থী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম। ওই আসনে নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে সালমা ইসলামের পক্ষে প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারী তার ছেলে শামীম ইসলাম দোহার ও নবাবগঞ্জ- দুই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ঢাকার জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়ে ভোট স্থগিত ও পুনর্নির্বাচনের আবেদন করেন। এই আবেদনের বিষয়ে তদন্ত করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক ও জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা আনিসুর রহমান।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১ আসনে অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রার্থী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম। তাকে ঘিরে দোহার-নবাবগঞ্জের মানুষের প্রাণে আশার সঞ্চার হয়। তিনি জনমানুষের নেতা হিসাবে সবার প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন। নির্বাচনে তার জয়ের সম্ভাবনাও ছিল শতভাগ। জনমত জরিপেও বিষয়টি উঠে আসে।
কিন্তু নির্বাচনের দিন সকাল থেকেই প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীর লোকজনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় সব কেন্দ্র। পরিস্থিতি করে তোলা হয় ভীতিকর। কেন্দ্র থেকে লাঙ্গল প্রতীকের পোলিং এজেন্ট বের করে দেওয়া, এজেন্টদের হুমকি, নাবালকদের দিয়ে ভোট প্রদান, জালভোট, কেন্দ্র দখল ও ভোটাদের প্রভাবিত করার মধ্য দিয়ে শেষ হয় এ আসনের নির্বাচন। ভয়ে অনেক ভোটার কেন্দ্রে যেতে পারেননি। যারা গিয়েছেন তাদের অনেকে ফিরে গেছেন ভয়ে। এ কারণে ভোটার উপস্থিত ছিল কম। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারাও ছিল ঢিলেঢালা। ভোট চলাকালেই নৌকার পক্ষে জালভোট দেওয়ার অভিযোগ করেন লাঙ্গলের প্রার্থী জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম।
দুপুর ১২টা পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকলে প্রিসাইডিং অফিসারদের কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে সালমা ইসলামের পক্ষে নির্বাচন কমিশনার আনিসুর রহমান, ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার ও ঢাকার জেলা প্রশাসন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের অবহিত করে প্রতিকার চাওয়া হয়। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এ আসনের ১৮৪টি কেন্দ্রের অধিকাংশই বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মীরা পরিদর্শন করেন। সরেজমিন দুপুরের দিকে বক্সনগর পাঠানকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জালভোট দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। দুপুর ২টা পর্যন্ত এ কেন্দ্রে ভোট পড়ে ১১২৯টি। এ কেন্দ্রে মোট ভোটার ২৭৮৯। সরেজমিন দেখা গেছে, সেখানে নারী ভোটার ছিলেন বেশি। মারমুখী অবস্থায় ছিল নৌকা মার্কার প্রার্থীর লোকজন।
হুমকি পেয়ে বড় বক্সনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে লাঙ্গলের ৫ জন পোলিং এজেন্ট বের হয়ে যান। নৌকার লোকজন তাদের প্রাণনাশের হুমকি দেয়। এরপর কাজ রেখে তারা কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যান। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রিসাইডিং অফিসার মতিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সকালে লাঙ্গলের পোলিং এজেন্টদের বুথে বসানো হয়। এরপর তারা চলে গেছেন, না আছেন- তা আমি বলতে পারছি না। নৌকার প্রার্থীর লোকজন প্রভাব খাটিয়ে ওই কেন্দ্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
জালভোটের অভিযোগ পাওয়া যায় দিঘীরপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রেও। দুপুর ২টায় ১৭ বছরের এক বালক আসে জালভোট দিতে। মিডিয়ার পক্ষ থেকে তাকে চ্যালেঞ্জ করা হলে সে ভোটকেন্দ্র থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরই একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আসেন কেন্দ্রটিতে। জালভোটের বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আমার সামনে এমন ঘটনা ঘটেনি। ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার আসমা আক্তার জানান, জালভোট দেওয়ার চেষ্টার বিষয়টি আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব।
দুপুর ১টায় মালিকান্দা মেঘুলা স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র দখলে নেয় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর শতাধিক নেতাকর্মী। তারা লাঙ্গল প্রতীকের পোলিং এজেন্টকে হুমকি-ধমকি দিয়ে বের করে দেয়। বিষয়টি প্রিসাইডিং অফিসার বাপি গুহর কাছে জানতে চাইলে তিনি এর সদুত্তর দিতে পারেননি। প্রিসাইডিং অফিসারের সঙ্গে আলাপকালে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীরা সাংবাদিকদের অবস্থানের কারণ জানতে চান। এসময় উভয়পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও বাগবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে ধস্তাধস্তি শুরু হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সাংবাদিকদের কেন্দ্র থেকে বের হতে সহযোগিতা করেন।
এছাড়া পদ্মা সরকারি কলেজ কেন্দ্রে ব্যাপক জালভোটের অভিযোগ আসে। এই কেন্দ্রে ভোটারদের জন্য সাতটি বুথ তৈরি করা হয়। সারা দিনেও এই কেন্দ্রে ভোটারদের কোনো লাইন চোখে পড়েনি। তবে ব্যতিক্রম ছিল দুপুর ১২টার দিকে মিনিট দশকের চিত্র। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন হঠাৎ তার সঙ্গে বিদেশি একজন পর্যবেক্ষককে নিয়ে কেন্দ্র পরিদর্শনে এলে আকস্মিকভাবে বেশ কয়েকজন যুবক ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে যান। পর্যবেক্ষক চলে যাওয়ার পরপরই লাইন ভেঙে ওই যুবকরা যে যার মতো চলে যান। কেন্দ্রটিতে মোট ভোটার ৩ হাজার ৮৩। নৌকা, সোনালী আঁশ ও হাতুড়ির এজেন্ট থাকলেও হুমকির মুখে লাঙলের কোনো এজেন্ট কেন্দ্রে যেতে পারেননি। কেন্দ্রটিতে ভোটারদের যাতায়াত তেমন চোখে না পড়লেও সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যেই প্রায় ১০০ ভোট পড়ে বলে জানান প্রিসাইডিং অফিসার তানজিল আহমেদ চৌধুরী।
দুপুর গড়াতেই ভোট পড়ার হার দাঁড়ায় ২৫ শতাংশ। বিস্ময়কর আরেক তথ্য পাওয়া যায় পূর্বচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। এই কেন্দ্রে মোট ভোটার ১৮৬৮ জন। চারটি বুথ। একটি বুথেও লাঙ্গলের এজেন্ট যেতে পারেননি। কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার ললিন বালো জানান, দুপুর ২টা পর্যন্ত ৬৫০ ভোট পড়েছে। অথচ এই কেন্দ্রে ভোটারদের কোনো লাইনই ছিল না। অব্যাহতভাবে ভোটারদের যাতায়াতও ছিল না। মাঝেমধ্যে দু-একজন ভোটারকে কেন্দ্রে আসতে দেখা গেছে। তাহলে এত ভোট পড়ল কিভাবে- এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি নির্বাচনি কোনো কর্মকর্তা। ৭০-ঊর্ধ্ব এক বৃদ্ধ কেন্দ্র থেকে বের হওয়ার সময় যুগান্তরকে বলেন, ব্যালট নেওয়ার পর এক যুবক তার হাত থেকে ব্যালট নিয়ে নৌকা প্রতীকে সিল দিয়ে দেন। এভাবেই চলে এ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ।
মেঘুলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সকাল থেকেই একতরফা আধিপত্য বিস্তার করে নৌকার সমর্থকরা। এখানেও লাঙল প্রতীকের কোনো পোলিং এজেন্ট যেতে পারেননি। কেন্দ্রটি এক প্রকার দখলে নিয়ে কৌশলে জালভোট দেওয়া হয়। যদিও বাইরের পরিস্থিতি ছিল শান্ত। আশপাশের প্রায় সব কেন্দ্রের পরিস্থিতিও ছিল একই।
দোহার, চর মাহমুদপুর পুলিশ ফাঁড়ি আবাসন কেন্দ্রে (৮নং কেন্দ্রে) ভোট গণনার সময় ৮নং ওয়ার্ডের মেম্বার আবুল কালাম উপস্থিত ছিলেন। বিষয়টি জানার পর তাকে বুথ থেকে বের করে দেওয়া হয়। এ সময় তিনি পোলিং এজেন্ট দাবি করলেও পরিচয়পত্র দেখাতে পারেননি।
সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বারুয়াখালি ইউনিয়নের বারুয়াখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লাঙ্গল প্রতীকের কোনো পোলিং এজেন্ট ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কেন্দ্রটির ভেতর ও বাইরে দখলে নেয় নৌকার নেতাকর্মীরা। এ সময় লাঙ্গলের ৫ জন এজেন্টকে হুমকি দিয়ে তারা বলে, কেন্দ্রের ভেতরই তো থাকতেই দেওয়া হবে না। এমনকি বাইরেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না লাঙ্গলের এজেন্টরা। সাড়ে ১০টার দিকে লাঙ্গলের ৫ এজেন্ট একত্রিত হয়ে প্রিসাইডিং অফিসার মোরশেদ আলমকে বিষয়টি জানান। তবে প্রিসাইডিং অফিসার তাদের সহযোগিতা না করে সাফ বলে দেন, সকাল ৮টার পর কেন্দ্রে আসায় লাঙ্গলের পোলিং এজেন্ট নেওয়া হবে না। ওই সময় ৫ এজেন্ট বিষয়টির প্রতিবাদ জানালে কেন্দ্রে থাকা পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা তাদের বের করে দেন। ভেতরে শুধু নৌকার এজেন্ট থাকায় নিজেদের ইচ্ছেমতো ভোটগ্রহণ করতে থাকেন প্রিসাইডিং অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মিডিয়াকর্মীদের উপস্থিতি টের পেয়ে নৌকার নেতাকর্মীরা কেন্দ্রের ভেতর থেকে সরে দাঁড়ান। এ সময় প্রিসাইডিং অফিসার মোরশেদ আলম বলতে থাকেন, তার ভুল হয়েছে। পরে কেন্দ্রের বাইরে থাকা পোলিং এজেন্টদের ডেকে কেন্দ্রের ভেতরে নেন মোরশেদ আলম। লাঙ্গলের কয়েকজন ভোটার জানান, মোরশেদ আলম নৌকার মাঝি হয়ে এ কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করছেন। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে নৌকার ৮-১০ জন নেতাকর্মী নিয়ে কেন্দ্রের ভোটকক্ষে প্রবেশ করেন বারুয়াখালি ইউপির চেয়ারম্যান এমএ বারি বাবুল মোল্লা। ওই সময় প্রিসাইডিং অফিসার দেখেও না দেখার ভান করেন। তিনি বলেন, মোল্লা সাহেব জনপ্রতিনিধি। তিনি প্রতিটা কক্ষে প্রবেশ করলেও কিছু করার নেই।
এদিকে আলালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রেও নৌকার নেতাকর্মী নিয়ে অবস্থান নেন ইউপি চেয়ারম্যান এমএ বারি বাবুল মোল্লা ও তার সহোদর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোশারফ মোল্লা। এই দুজনের নেতৃত্বে কেন্দ্রটিতে জালভোট চলে। বিকাল পৌনে ৪টার দিকে কেন্দ্রের প্রধান গেট দিয়ে হুড়হুড় করে নেতকর্মীদের প্রবেশ করান দুই ভাই। এ সময় চেয়ারম্যান বারি বাবুল মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। শেষ পর্যায়ে তারা ভোট দিতে কেন্দ্রে প্রবেশ করছেন। এদিকে লাঙ্গলের একাধিক পোলিং এজেন্ট জানান, শুরু থেকেই কেন্দ্রটিতে নৌকার পক্ষে জালভোট প্রদান করা হয়। দুপুরের পর জালভোট চলে এক প্রকার প্রকাশ্যেই। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেতা মোশারফ হোসেন বলেন, এই ইউনিয়নের কেন্দ্রগুলো তাদের দখলেই থাকে। ভেতরে জালভোট কে বা কারা দিচ্ছে তা তিনি জানেন না। অথচ সরেজমিন দেখা যায়, তিনি এবং তার চেয়ারম্যান ভাই মানুষকে ডেকে ডেকে কেন্দ্রে প্রবেশ করাচ্ছেন। একজন আনসার সদস্য বলেন, তারা (দুই ভাই) কেন্দ্রে যা ইচ্ছে তাই করছেন। কেন্দ্রের কয়েক ফুট দূরত্বে তাদের বাসা। আলালপুর কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা পরিমল বিশ্বাস বলেন, আপনারা যা দেখছেন, আমরাও তা দেখছি। যারা ভোট দিতে আসছেন, তাদের চিহ্নিত করছেন পোলিং এজেন্টরা। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি সুষ্ঠু ভোট করতে।
জয়কৃষ্ণপুর ইউপির ৪নং কঠুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে নৌকার পক্ষে বহিরাগত লোকজন অবস্থান করে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত। ভোট দিতে লাইনে দাঁড়ানো লোকজনের হাতে নৌকার স্লিপ ধরিয়ে দিচ্ছিল তারা। দুপুরের পর কেন্দ্রটিতে জাল ভোট দিতে শুরু করে নৌকার প্রার্থীর নেতাকর্মীরা। সরেজমিন দেখা যায়, নৌকার নেতাকর্মীরা কিছুক্ষণ পরপর ৫-৬ জন যুবককে একত্রিত করে ভোটকক্ষে পাঠাচ্ছে। বিকাল ৩টার দিকে কেন্দ্রের একটি বুথে ১৪/১৫ বছর বয়সি এক যুবক নৌকার স্লিপ নিয়ে প্রবেশ করে। এ সময় এক আনসার সদস্য তার নাম, বাবা ও মায়ের নামসহ তার জন্মতারিখ জানতে চাইলে ওই যুবক কিছুই বলতে পারেনি। জন্মতারিখও বলতে পারেনি। একপর্যায়ে সাংবাদিক দেখে কেন্দ্রটির প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ভুপাল বল ছুটে আসেন। তিনি এসে জাল ভোট দিতে আসা যুবককে ধরে নিয়ে কক্ষ থেকে বের করে দেন।
দোহার পৌরসভার নটাখোলা আজহার আলী মেমোরিয়াল (পূর্ব নটা) কেন্দ্রে তৃণমূল বিএনপির পোলিং এজেন্টের ছদ্মবেশে নৌকার সমর্থক এজেন্ট হয়েছে। এমন বেশকিছু অভিযোগ পাওয়া যায়।
নবাবগঞ্জ কেপিআর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রিসাইডিং অফিসার মো. আলী হোসেন সাংবাদিকদের কাজে বাধা দেন। নির্বাচন কমিশনের দেওয়া পর্যবেক্ষক কার্ড থাকা সত্তে¡ও সাংবাদিকদের কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এই কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া প্রিসাইডিং অফিসার ও পুলিশ কেন্দ্র থেকে সাংবাদিকদের বের করে দেন। সাংবাদিকদের কাজে বাধা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রিসাইডিং অফিসার আলী হোসেন বলেন, আপনাদের কেন্দ্রে ঢুকতে ইউএনও নিষেধ করেছেন। ওই কেন্দ্রের কয়েকজন ভোটারের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের এজেন্টরা ভোটারদের নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করছেন।
এখানেই শেষ নয়, লাঙ্গলের পোলিং এজেন্টদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি, কেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। মকসুদপুর ইউনিয়নের ৬৫নং মৌড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (দক্ষিণ মৌড়া) কেন্দ্রে ও সংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পুরো কেন্দ্র ঘুরে ৭টি বুথের কোনোটিতেই লাঙ্গল প্রতীকের এজেন্ট পাওয়া যায়নি। তারা টিকতে না পেরে চলে যান। এই কেন্দ্রে নৌকা, হাতুড়ি ও সোনালী আঁশের পোলিং এজেন্ট ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীর এজেন্ট খুঁজে পাওয়া যায়নি। একই চিত্র ছিল মুহিতপুর দাখিল মাদ্রাসা ও ধীৎপুর শহীদ শাকিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। এই কেন্দ্রগুলোর পোলিং এজেন্টরা অভিযোগ করেন, আগেরদিন লাঙ্গলের পোলিং এজেন্টদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নৌকার নেতাকর্মীরা হুমকি দিয়েছে। নির্বাচন চলাকালে তাদের পোলিং এজেন্টের দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয়নি।
শোল্লা ইউনিয়নের এম মহিউদ্দিন ভূঁইয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে সকাল ১০টার দিকে দেখা যায়, সরকার দলীয় লোকজন কেন্দ্র ঘিরে রেখেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই তারা নৌকায় ভোট চাচ্ছেন। সাধারণ ভোটারদের তারা নানাভাবে প্রভাবিত করছেন। প্রতিটি বুথে নৌকার একাধিক এজেন্ট বসে থাকতে দেখা গেছে। তরুণ ভোটারদের অনেকেই একাধিক ভোট দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। তারা বলেন, বারবার বিভিন্ন বুথে গিয়ে ভোট দিয়ে দাপটের সঙ্গে বের হয়ে যান তারা। দুপুর ৩টার পরে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্রের প্রতিটি কক্ষ দখলে নেন। এ সময় তারা দলবদ্ধ হয়ে জাল ভোট দেন। গণমাধ্যম কর্মীদের উপস্থিতি টের পেয়ে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে যান তারা।
সরেজমিন আরও দেখা যায়, অনেকে ভোট দিয়ে বের হয়ে হাতের কালি মুছে নিচ্ছেন। হাত পরিষ্কার করে আবারও কেন্দ্রে ঢুকে ভোট দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এই কেন্দ্রে দায়িত্বরত প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান বলেন, বিষয়টি আমি অবগত হয়েছি। এরপর আর এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে সে বিষয়ে তৎপর থাকব।
দোহার কার্তিকপুর ইউনিয়নের ৩৮নং চর হোসেনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে অন্যের ভোট দিতে এলে এক যুবকসহ ৩ নারীকে ধরে ফেলেন সাংবাদিকরা। তাদের জেরার মুখে পড়ে যুবক বলেন, বাহির থেকে আমাকে এই স্লিপ ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও এ কেন্দ্রে আরও একজন মহিলা ভোটার অভিযোগ করেন, তার ভোট অন্য কেউ দিয়ে গেছেন। তিনি ভোট দিতে পারেননি। প্রিসাইডিং অফিসারকে এই বিষয়ে জানানো হলে তিনি আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলে জানান।
এদিকে সুতারপাড়া ইউনিয়নের হয়রত বিলাল (রা.) মাদ্রাসার (পশ্চিম সুতারপাড়া) কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার ইমরান হোসাইন বলেন, সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত মোট ৩৩৯টি অর্থাৎ ২২ শতাংশ ভোট পড়েছে। এই কেন্দ্রে দুপুর ২টা ২০ মিনিটে একসঙ্গে ১২ থেকে ১৪ জন নারী-পুরুষ কেন্দ্রে ঢুকলেও সাংবাদিক ও দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের তোপের মুখে পড়েন তারা। এ সময় জাল ভোট দিতে আসা কয়েকজন নারী- পুরুষ পালিয়ে যান। একজন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার বুথে বসেই মোবাইলে কথা বলছিলেন, সাংবাদিক নিষেধ করার পর প্রিসাইডিং অফিসারের রুমে মোবাইল রেখে আসেন। সব মিলে এই কেন্দ্র খ্বুই অরক্ষিত ছিল।
তবে এ ব্যাপারে প্রিসাইডিং অফিসার ইমরান হোসাইন মনগড়া ব্যাখা দেন। কেন্দ্র সুরক্ষিত বলে দাবি করেন তিনি।
নারিশার কেন্দ্রে জাল ভোটের উৎসব : নারিশা ইউনিয়নের প্রায় সব কেন্দ্রেই জাল ভোট দিয়েছে নৌকার সমর্থকরা। এর মধ্যে কয়েকটিতে দায়িত্বরত কর্মকর্তার কাছ থেকে ব্যালট পেপার নিয়ে সিল মারা হয়েছে। কোনোটিতে আবার একই ব্যক্তি একাধিকবার অথবা ভোটার নন এমন ব্যক্তিরা ভোট দিয়েছে। ভোট জালিয়াতির জন্য নারীদের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক জায়গায় নৌকার সমর্থকরা লাঙ্গলের প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছেন। এই অনিয়মের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছেন অনেক সাংবাদিক।
সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে নারিশা উচ্চবিদ্যালয়, নারিশা পশ্চিম চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নারিশা খালপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মালিকান্দা মেঘুলা স্কুল ও কলেজ, উত্তর শিমুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঝনকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। দিনভর এসব কেন্দ্র এলাকায় শোডাউন দেয় নৌকার সমর্থকরা। কেন্দ্রের ভেতর ঢুকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়। এত কিছুর পরেও নির্বিকার ছিল প্রশাসন।
পশ্চিম চর নারিশা উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বেলা ১১টায় বিপুলসংখ্যক নারী ভোট দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। লাইনে দাঁড়ানো বেশিরভাগই আসলে ডামি/ভুয়া ভোটার। তারা মূলত জাল ভোট দিতে এসেছেন। কিছুক্ষণ পর বিজিবি’র একটি টিম এলে পালিয়ে যায় ডামি ভোটাররা। তাদের পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য যুগান্তরের ক্যামেরায় ধরা পড়ে। এমন ভুয়া ভোটারদের কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, আমাদের কাছে আইডি কার্ড নেই। আমাদের একজন বলেছে এখানে আসতে তাই আমরা এসেছি। আমাদের কোনো দোষ নেই। এ ব্যাপারে ওই কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা প্রিসাইডিং অফিসারকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি এর সদুত্তর দিতে পারেননি। এর কিছুক্ষণ পর বেলা ১২টার দিকে আবারও কয়েকজন নারী ভোটার উপস্থিত দেখা যায় একই কেন্দ্রে। লাইনে দাঁড়ানো একজন বুথে প্রবেশ করেন ভোট দিতে। এ সময় তার হাতে থাকা আইডি কার্ডের তথ্যের সঙ্গে ভোটার তালিকার তথ্যের অমিল পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে প্রিসাইডিং অফিসার বলেন, উনি ভুল করে অন্যের আইডি কার্ড নিয়ে এসেছেন।
এদিকে সংবাদকর্মীদের দেখে তাদের দিকে তেড়ে আসেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তার সঙ্গে ছিলেন নৌকার সমর্থক নারিশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন। কিছুক্ষণ পর ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করেন নৌকা মার্কার প্রার্থী সালমান এফ রহমানের প্রধান নির্বাচন সমন্বয়ক। তিনিও সাংবাদিকদের দিকে দলবল নিয়ে তেড়ে আসেন। বলতে থাকেন, সাংবাদিকরা কেন কেন্দ্রে প্রবেশ করে!
নারিশা ইউনিয়নের সাতভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সকাল থেকেই ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে ভোটাররা কেন্দ্রে আসতে শুরু করেন। তবে দীর্ঘ লাইন চোখে পড়েনি। বিকালের আগ পর্যন্ত পুরো সময় ভোটকেন্দ্র খালি ছিল। বিকাল গড়াতেই কেন্দ্রের চিত্র পুরোটা পালটে যায়। হঠাৎ শিশু-কিশোরদের দিয়ে নৌকা প্রার্থীর ব্যালটে ভোট দেওয়ানো হয়। তবে কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মো. সোহেল রানা দাবি করেন, কেন্দ্রে কোনো জাল ভোটের খবর তার কাছে নেই।