দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রচারের শেষদিকে এসে বেপরোয়া আচরণ করছেন অনেক প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) এবং আচরণবিধির লঙ্ঘন করে প্রচার চালাচ্ছেন তারা। এছাড়া ভোটার টানতে টাকা বিতরণ, প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, প্রচারে বাধা, নির্বাচনি ক্যাম্প ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছেন বেশ কয়েকজন প্রার্থী ও তাদের কর্মীরা।
নির্বাচন কমিশন সতর্ক করার পরও বারবার নির্বাচনি অপরাধ করেছেন অনেক প্রার্থী। চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে সরকারের বেশকিছু কর্মকর্তাও বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন। অনেক প্রার্থী প্রশাসনকে পক্ষে পেতে নানা ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছেন।
শুধু তাই নয়, প্রশাসনকে হুমকি-ধমকি দেওয়ার ঘটনাও রয়েছে। এমনই এক ঘটনা ঘটেছে লক্ষ্মীপুরে। ওই জেলার প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারকে (এসপি) বদলির হুমকি দেওয়ায় লক্ষ্মীপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান পাবনকে সোমবার তলব করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে বরগুনা-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভুকে জরিমানার পর আবারও একই ধরনের অভিযোগে শোকজ করা হয়েছে।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, মাঠ পর্যায়ে উত্তাপ ততই বাড়ছে। নির্বাচন কমিশনেও পক্ষে-বিপক্ষে অভিযোগ জমা পড়ার সংখ্যাও বাড়ছে। মূলত আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যেই বেশি দ্বন্দ্বের তথ্য ইসিতে জমা হচ্ছে। তারা আরও জানান, আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় রোববার পর্যন্ত ৪৩৬ জনকে শোকজ করেছে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। এর মধ্যে ১১৬টি শোকজ করা হয়েছে ঢাকা অঞ্চলভুক্ত আসনগুলোয়। রাজশাহী অঞ্চলে ৬৬ এবং কুমিল্লা অঞ্চলে ৬৪ জনকে শোকজ করা হয়েছে। ৪৩৬টি শোকজের ঘটনায় ২৭৩টি তদন্ত প্রতিবেদন নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়েছেন নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যানরা। ওই সময়ের মধ্যে মাত্র ৫৮টি তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ব্যবস্থা নিয়েছে ইসি।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাত্র চারদিন প্রচারের সময় রয়েছে। ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টায় প্রচার শেষ হবে। ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ১৯৪৩ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাদের মধ্যে ৪১৪ জনই স্বতন্ত্র প্রার্থী। বাকি ১৫২৯ জন ২৮টি রাজনৈতিক দলের প্রার্থী। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ২৬৬ জন।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে রোববার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে চার শতাধিক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ নির্দেশনা দেন। ম্যাজিস্ট্রেটদের উদ্দেশে তিনি বলেন, নির্বাচনে আপনাদের দৃষ্টিতে যদি কোনো রকম অনাচার ধরা পড়ে এবং সেখানে যদি আপনাদের এখতিয়ার থাকে প্রতিহত করার, তাহলে অবশ্যই আপনার বৈধ ক্ষমতা দিয়ে সেটি করবেন। আমি বিশ্বাস করি, সবার মিলিত প্রয়াসে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে এবং দেশে ও বহির্বিশ্বে প্রশংসিত হবে। জনগণের কাছে নির্বাচনটা বিশ্বাসযোগ্য হবে।
ডিসি-এসপিকে হুমকি স্বতন্ত্র প্রার্থীর : লক্ষ্মীপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান পবন শনিবার সন্ধ্যা ৭টা ২২ মিনিটের দিকে জেলা প্রশাসককে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দিয়ে অকথ্য ও আপত্তিকর ভাষায় কথা বলেন। ডিসি ও এসপিকে তিনদিনের মধ্যে বদলি করার হুমকি দেন। এ ঘটনায় তাকে আজ নির্বাচন কমিশনে তলব করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
আরও জানা যায়, লক্ষ্মীপুরের ডিসি ও রিটার্নিং কর্মকর্তা সুরাইয়া জাহান শনিবার নির্বাচন কমিশনে এক প্রতিবেদন পাঠান। ওই প্রতিবেদনে এ প্রার্থীর বিরুদ্ধে একাধিকবার এ ধরনের আচরণ করার অভিযোগ আনেন। প্রতিবেদনের সঙ্গে ১১ পৃষ্ঠার একটি সংযুক্তি দেন। সেখানে তার বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে পুলিশের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।
জরিমানার পরও শোকজ শম্ভুকে : বরগুনা-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভুকে তলব করেছে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। ৩০ ডিসেম্বর প্রতিপক্ষ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কট‚ক্তি করায় শনিবার তাকে শোকজ করা হয়। শোকজের সময় থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে। এর আগে তাকে আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় ইসি ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিল।
উপজেলা চেয়ারম্যানকে তলব : পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মিরাজুল ইসলাম মিরাজকে তলব করেছে পিরোজপুর জেলা নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। রোববার তাকে দেওয়া এক চিঠিতে সোমবার ওই বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলেছেন নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যান কেএম মহিউদ্দীন।
নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির চিঠিতে বলা হয়েছে, আপনি মিরাজুল ইসলাম মিরাজ (উপজেলা চেয়ারম্যান, ভান্ডারিয়া) ২৪ ডিসেম্বর পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার ভিটাবাড়িয়া ইউনিয়নের আহজারীয়া মাদ্রাসার মাঠে অনুষ্ঠিত স্বতন্ত্র প্রার্থীর এক নির্বাচনি জনসভায় দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশক তারিন ও তার পিতা নৌকা প্রতীকধারী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং তার পরিবার নিয়ে আপত্তিকর এবং মানহানিকর বক্তব্য প্রদান করেছেন। ওই সভার ভিডিও রেকর্ডিং ধারণ করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হয়। ভিডিও রেকর্ডিং অত্র কমিটির কাছে সংরক্ষিত আছে। আপনার এরূপ কাজ সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ১১(ক)-এর লঙ্ঘন হয়েছে মর্মে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়। এ ঘটনায় কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
প্রতিপক্ষকে হুমকি-ধমকি : ইসি সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন স্থানে প্রতিপক্ষকে হুমকি-ধমকি দেওয়ার বিভিন্ন তথ্য আসছে নির্বাচন কমিশনে। ফেনী-৩ আসনের নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যান খাইরুননেছা রোববার ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার ১নং সিন্দুরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নুর নবীকে শোকজ করেন। ওই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীর এক সমর্থককে তার এলাকায় পোস্টার লাগাতে নিষেধ করেছেন। আর পোস্টার লাগালে ‘মেরে লাশ গুম’ করার হুমকি দেন তিনি। বরিশাল-৬ আসনের বাকেরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র লোকমান হোসেন ডাকুয়াকে হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগে রোববার শোকজ করেছে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। ২৬ ডিসেম্বর কলসকাঠিতে উঠান বৈঠকে প্রতিপক্ষ নৌকার সমর্থকদের পাঁচ মিনিটও মাঠে টিকতে দেবেন না বলে হুমকি দেন। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় ও মনিটরিং সেল গঠন : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ মনিটরিংয়ে ১০ সদস্যের ‘সমন্বয় ও মনিটরিং সেল গঠন’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের আইডিয়া প্রকল্প-২ পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সায়েমের নেতৃত্বে এ কমিটিতে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের সদস্যরা রয়েছেন।