চট্টগ্রাম বন্দরে ১৯৭২-৭৪: যেভাবে মাইন সরিয়েছিলেন সোভিয়েতের ভিটালি
কূটনৈতিক প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৪৩ পিএম
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে ভিটালি গুবেনকোর বয়স ছিল ৩০ বছর। বর্তমানে তার বয়স ৮০ বছরের বেশি। তিনি ছিলেন তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের নৌবাহিনীর একজন সিগন্যালম্যান। ঢাকা ও মস্কোর মধ্যে বার্তা আদান-প্রদানের দায়িত্ব ছিল তার।
তবে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের নৌবাহিনী চট্টগ্রাম বন্দরে মাইন অপসারণ এবং ধ্বংস হয়ে যাওয়া কিংবা ডুবে যাওয়া অনেক জাহাজ উদ্ধারের যে কাজ করেছে; তিনি ছিলেন সেই অভিযানের অন্যতম সদস্য। কাজটা যে কঠিন ছিল সেটা তিনি নিজেই বলেছেন। ওই সময়ে কর্তব্য পালন করতে গিয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সি নাবিক ইউরি রেদকিন তার প্রাণ দেন। বাংলাদেশের মাটিকে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মানে সমাহিত করা হয়।
মহান বিজয় দিবস উদ্যাপন উপলক্ষ্যে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর দুটি প্রতিনিধিদলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল বাংলাদেশ। সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন বিলুপ্ত। ভিটালি গুবেনকো সরকারিভাবে রাশিয়ার প্রতিনিধিদলের হয়ে বাংলাদেশ সফর করেন। বিজয় দিবস উদযাপনের রাষ্ট্রীয় নানা আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নেন তিনি।
মঙ্গলবার ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পূর্বে ঢাকায় রুশ দূতাবাসে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ওই সময়ে বাংলাদেশে কাজ করার স্মৃতিচারণ করেন রুশ নৌবাহিনীর এই সাবেক কর্মকর্তা।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- ঢাকায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকসান্দার মান্তিৎস্কি। বাংলাদেশে আরব বসন্তের আশঙ্কা করে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাকারুভার মন্তব্য নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রুশ রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে কোনো প্রতিযোগিতা করছে না রাশিয়া। আমরা শুধু এটাই বলেছি যে, তারা কী করছে বা কী করেছে।
মুক্তিযুদ্ধকালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে সমর্থন জানিয়েছিল। দেশটি তখন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের পক্ষে সহায়তা দেয়। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে অচল সমুদ্রবন্দর চালু করার জন্য জাতিসংঘের সহায়তার আবেদন করে বাংলাদেশ। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে বন্দর চালু করার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন সেটি তখন জোগাড় করা সম্ভব হয়নি বলে জানান রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম বন্দর সচল করার জন্য মস্কোকে অনুরোধ করেন। মস্কো দ্রুততার সঙ্গে রাজি হয় এবং ওই মাসেই এ বিষয়ে চুক্তি সই হয়। সম্পূর্ণ মানবিক কারণে সোভিয়েত নেভি ওই কাজ করেছে। যদিও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ওই কাজের জন্য এক কোটি ডলার চেয়েছিল।
ভিটালি গুবেনকো বলেন, যুদ্ধের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর অচল হয়ে পড়েছিল। সোভিয়েত প্যাসিফিক নেভি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরে মাইন অপসারণ এবং ডুবে যাওয়া জাহাজ উদ্ধার করে। বিজয় দিবস উদ্যাপন করতে এসে তিনি চট্টগ্রামে যেসব স্থানে কাজ করেছিলেন; ওই সব স্থান পরিদর্শন করেন। তার সহকর্মী ইউরি রেদকিনের সমাধিস্থল পরিদর্শন করেন।
তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে দ্রুত সাড়া দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। এ সহায়তার লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি সই হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের এটা ছিল সম্পূর্ণ মানবিক সহায়তা। এই কাজে সোভিয়েত ইউনিয়ন কোনো অর্থ নেয়নি। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে কাজটি করেছে। অর্থ দিয়ে করাতে এ কাজে তখন এক কোটি ডলার প্রয়োজন ছিল। ১৯৭২ সালের ২৬ এপ্রিল প্রথম সোভিয়েত মাইনসুইবার চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে। পশ্চিমা হিসাবে পুরো কাজ সম্পন্ন করতে তিন থেকে পাঁচ বছর সময়ের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন এই কাজ ২৬ মাসে সম্পন্ন করে।
ভিটালি গুবেনকো বলেন, রিয়ার অ্যাডমিরাল সার্গেই জুয়েনকো এক হাজার নাবিক নিয়ে দুই হাজার টন ধাতব ও মাইন ওজনের ২৬টি জাহাজ উত্তোলন করেন। ফলে মানবিক সাহায্য এবং বাণিজ্যিক পণ্যের জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে থাকে। ওই অভিযানের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হয়েছিল। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ক্ষুধার হাত থেকে রক্ষা পায়।