ভোক্তা না কেনায় গুদামে নষ্ট হচ্ছে পেঁয়াজ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৫৫ পিএম
এবার পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে সেই শক্তিশালী আড়তদার সিন্ডিকেট। তাদের কারসাজিতে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ২০০-২৪০ টাকা ঠেকানো হয়, যা ১১০-১৩০ টাকা ছিল। এবারই প্রথম নীরব প্রতিবাদ হিসাবে বাড়তি দাম দিয়ে পেঁয়াজ কেনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন ভোক্তা। ফলে পণ্যটি না কেনায় আড়ত থেকে সরবরাহ কমে যায়। অনেক গুদামেই নষ্ট হচ্ছে পেঁয়াজ। বস্তাবন্দি থাকায় পচন ধরেছে পেঁয়াজে।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের পর থেকেই বাজারে নৈরাজ্য চলছে। তবে এবারই প্রথম ভোক্তারা এক হয়েছেন। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পেঁয়াজ কেনা থেকে বিরত থাকতে প্রচারণা চালানো হয়েছে। ফলে ক্রেতারা বাড়তি দরে পেঁয়াজ কেনা থেকে বিরত ছিলেন। অতিপ্রয়োজন না হলে কেউ পেঁয়াজ কেনেননি। পাশাপাশি দেশি নতুন পেঁয়াজ পুরোদমে বাজারে আসতে শুরু করেছে। ফলে দিশেহারা হয়ে সেই শক্তিশালী সিন্ডিকেট পেঁয়াজের দাম কমাতে শুরু করেছে।
মঙ্গলবার রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৮০-২০০ টাকা। একদিন আগে ২২০-২৪০ টাকা ছিল। তবে বৃহস্পতিবার প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ১৩০ টাকা। পাশাপাশি আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজের সরবরাহ বাজার খুব কম। তবে যেসব দোকানে পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৬০-১৮০ টাকা, যা একদিন আগে ২০০ টাকা ছিল। আর বৃহস্পতিবার বিক্রি হয়েছিল ১১০ টাকা। এছাড়া রাজধানীর খুচরা বাজারে পাতাসহ পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা কেজি। মুড়ি কাটা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৩০-১৪০ টাকা।
রাজধানীর কাওরান বাজারের পেঁয়াজ বিক্রেতা মো. হাবিবুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় আমদানিকারকদের উসকানিতে আড়তদাররা এবার পেঁয়াজের দাম বাড়াতে শুরু করে। ফলে দেশের সব স্থানে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়। এছাড়া খুচরা ব্যবসায়ীদেরও কিছুটা কারসাজি ছিল। তবে এবার আড়তদাররা আড়ত থেকে পেঁয়াজ সরিয়ে ফেলে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সুবিধা করতে পারেননি। কারণ, বাজারে নতুন পেঁয়াজ উঠে গেছে। ক্রেতারা বাড়তি দামে পেঁয়াজ কেনা থেকে বিরত ছিলেন। যার দরকার হয়েছে, মুড়ি কাটা ও পাতাসহ পেঁয়াজ কিনছেন। সঙ্গে যে পেঁয়াজ আড়ত থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল, বাজারে তদারকির কারণে সেগুলো আসতে পারছে না। ফলে গুদামে নষ্ট হচ্ছে পেঁয়াজ। অনেক ক্ষেত্রে বস্তায় পেঁয়াজে পচন ধরেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর শ্যামবাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী যুগান্তরকে বলেন, বৃহস্পতিবারও শ্যামবাজারে আড়তে পেঁয়াজ ছিল। সেদিন আড়ত থেকে হঠাৎ দাম বাড়ানো হয়। অনেকেই শ্যামবাজারের আড়ত থেকে অন্যান্য গুদামে পেঁয়াজ সরিয়ে নেন, যা ইতোমধ্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানে প্রকাশ পায়। শ্যামবাজারে অভিযান পরিচালনা চলমান থাকায় যারা পেঁয়াজ সরিয়ে নিয়েছেন, তারা এখানকার আড়তে পেঁয়াজ আনতে পারছেন না। এছাড়া দেশি নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসায় আগের পুরোনো পেঁয়াজ ক্রেতার প্রয়োজন হচ্ছে না। ফলে সব মিলে লুকিয়ে রাখা পেঁয়াজ লুকিয়েই নষ্ট হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের সাধারণ পাইকারি ব্যবসায়ী হাসান বলেন, খাতুনগঞ্জে তিন থেকে চার দিন পেঁয়াজের দাম বাড়ালেও এখন কমানোর পাঁয়তারা চলছে। কারণ, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ক্রেতা কমে গেছে। খুচরা ব্যবসায়ীদের আনাগোনা একেবারেই নেই। ফলে আড়তদাররা বিপাকে পড়েছেন। তিনি বলেন, এখানকার অনেক আড়তদার বাড়তি মুনাফা করার জন্য আড়ত থেকে পেঁয়াজ অন্য গুদামে সরিয়েছিলেন। বাজারে জেলা প্রশাসন ও ভোক্তা অধিদপ্তরের তদারকি চলমান থাকায় সেসব পেঁয়াজ আড়তে আনতে পারছেন না। ফলে বিক্রি না করতে পারায় পচে নষ্ট হচ্ছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতি সূত্র জানায়, ভারত পূর্বঘোষণা ছাড়াই বৃহস্পতিবার রাতে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেয়। এতে দেশে যে পেঁয়াজ পাইকারি কিংবা খুচরা ব্যবসায়ীদের হাতে ছিল, তা ভোক্তারা কিনে নিয়ে গেছেন। এখন অনেকের ঘরে বেশি করে পেঁয়াজ রয়েছে। অনেকের এক মাসও আর পেঁয়াজ লাগবে না। দাম বাড়ায় নতুন করে অনেকেই পেঁয়াজ কেনেনি। ফলে দুদিন পেঁয়াজের দাম বাড়তি থাকলেও এখন খাতুনগঞ্জে ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। দামেও ধস নেমেছে। অনেক আড়তে চায়না পেঁয়াজে পচন ধরেছে। পাশাপাশি এখন এ মৌসুমের দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করেছে। কয়েকদিনের মধ্যে পুরোদমে দেশি পেঁয়াজ বাজারে এলে দাম স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এখানে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়, ব্যবসায়ীরা পণ্য কিনে এনে বিক্রি করেন। কে বিক্রি করবে, কে করবে না, সেখানে কারও চাপ সৃষ্টির কথা নয়। ব্যবসায়ীরাই পণ্যের সাপ্লাই চেইন ঠিক রেখেছেন। কারণ, বেসরকারি আমদানিকারকরাই ঝুঁকি নিয়ে পণ্য আমদানি করেন। ব্যবসায়ীরা তো অপরাধী নন। তাহলে ভোক্তা অধিকার কিংবা প্রশাসনের এখানে যে অভিযানের কথা বলা হচ্ছে, তা মানহানিকর।
কনজুমারস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন মালেক বলেন, যারা পেঁয়াজ অনৈতিকভাবে সরিয়েছে, তাদেরও সেসব পেঁয়াজ খুঁজে বের করা দরকার। এ পেঁয়াজের সব বিক্রি হয়নি। আড়তদার মজুতদারদের কাছে পেঁয়াজ আছে।
জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, এবার পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর পেছনে রাজধানীর শ্যামবাজার ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের আড়তদাররা জড়িত। আমরা তাদের কিছু চিহ্নিত করেছি। পাশাপাশি বাকিদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। সবাইকেই আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তিনি বলেন, এফবিসিসিআই একটি বড় ব্যবসায়ী সংগঠন। এবার ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের পর যেসব আড়তদার মূল্য কারসাজি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে এফবিসিসিআই-এর পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আমি আশা করছি।
প্রসঙ্গত, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৭-২৮ লাখ টন। এর মধ্যে স্থানীয় উৎপাদন ২৫ লাখ টনের বেশি। বাকি জোগান আমদানির মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে ভারত থেকে আসে সিংহভাগ পেঁয়াজ। চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত দেশে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৮৫ হাজার টন। ফলে চাহিদার বেশি পেঁয়াজ থাকার পরও দেশে মূল্য নিয়ে কারসাজি করা হয়।