নির্বাচনের পর চার খাতে সংস্কারের বিকল্প নেই

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২৩, ১১:০০ পিএম

টেকসই অর্থনীতির জন্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর চার খাতে সংস্কারের বিকল্প নেই। এগুলো হলো- আর্থিক খাতে সংস্কার, মুদ্রা বিনিময় হার নির্ধারণ, রাজস্ব ঘাটতি পূরণ এবং রপ্তানি আয় বাড়ানো। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট একসঙ্গে তৈরির ঘটনা এবারই প্রথম বলে মনে করছে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)।
সংস্থাটির মতে, বর্তমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদ্যোগে সন্তুষ্ট রয়েছে আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল)। বৃহৎ কোনো শক্তির হস্তক্ষেপ না থাকলে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ পাওয়া যাবে। মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে এসব বিষয় তুলে ধরে পিআরআই।
রাজধানীর বনানীতে নিজস্ব কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে লিখিত বক্তব্য দেন পিআরআই’র নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। বক্তব্য রাখেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক ড. এমএ রাজ্জাক।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, রাজনীতি ঠিক না থাকলে অর্থনীতি ঠিক থাকবে না। গত দুবার জাতীয় নির্বাচনের সময় বিদেশি সম্পৃক্ততা তেমন ছিল না। কিন্তু এবার আছে। এ বছর অন্য দুবারের মতো নির্বাচন হবে না। নির্বাচন নিয়েও অনিশ্চয়তা আছে। নির্বাচনের পরও যে শান্তি থাকবে, সে কথাও বলা যাচ্ছে না।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রথমবারের মতো এবারই রাজনীতি ও অর্থনীতি দুই বিষয়েই একই সঙ্গে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, রিজার্ভ কমে যাওয়া, বিনিময় হার এসব নিয়ে অর্থনীতি চাপে আছে। আইএমএফ এসব বিষয়ে সংস্কার করতে বলেছে। কিন্তু নির্বাচনের আগে এসব সংস্কার করা সম্ভব নয়। তাই মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের আশপাশেই থাকবে। বিনিময় হার কোথায় ঠেকবে, বলা যাচ্ছে না। নির্বাচনের পরেও যে এসব সংস্কার হবে, সেই দিকনির্দেশনাও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে বড় ধরনের সংস্কার করতেই হবে। আমরা আশা করছি নির্বাচনের পরই এসব খাতে সংস্কার আনা হতে পারে। এমনিতেই সংস্কারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। এখন যদি শুরু করতে আবারও দেরি হয় তাহলে সেটি হবে অনেক পিছিয়ে যাওয়া। সংস্কার কারও চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। এটা নিজেদের স্বার্থে আরও আগে থেকেই শুরু করা উচিত ছিল।
তিনি আরও বলেন, আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পেতে বড় কোনো সমস্যা হবে না, যদি বৃহৎ শক্তিধর কোনো দেশ বাধা না দেয়। এ বিষয়ে উদাহরণ দিয়ে ড. মনসুর বলেন, আমি আইএমএফের মিশন প্রধান হিসাবে সুদান সফরে গিয়েছিলাম। সুদান তখন আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির মধ্যে ছিল। তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারছিল না। তখন আমরা বলেছি, তাদের ঋণের কিস্তি আপাতত পরিশোধ করতে হবে না। শুধু সংস্কার করলেই হবে। এমন প্রস্তাব আইএমএফের বোর্ডে ওঠার আগের রাতে জি-১০ এই প্রস্তাবে আপত্তি জানায়। ফলে সেই প্রস্তাব পাশ হয়নি। তবে এটি রেয়ার কেস। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে এমনটা হবে সেটি নয়।
আহসান এইচ মনসুরের মতে, অর্থনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি এবার আরও কিছু নতুন ইস্যু এসেছে। যেমন শ্রম ইস্যু বড় হয়ে গেছে। এটির এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। শ্রম পরিবেশ ঠিক করতেই হবে। মানবাধিকার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। এসব বিষয়ে জবাবদিহির মধ্যে পড়তে হবে সরকারকে। কিন্তু এসব বিষয়ে অতীত রেকর্ড ভালো নয়। ভালো করতে হবে। অর্থনীতির চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি অর্থনীতি বাইরের নানা চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে, যা অর্থনীতিকে আরও চাপে ফেলছে।
তিনি বলেন, ডলার সম্পর্কে ভুয়া তথ্য যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। এসব পরিহার করতে হবে। চলমান সংকট মোকাবিলা করতে চার দেশ থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার নেওয়ার প্রক্রিয়া আছে। সেটি দোষের কিছু নয়। বরং সংকট কাটাতে এটা সরকারের একটা ভালো উদ্যোগ। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কর নীতি ও কর প্রশাসন আলাদা হওয়া দরকার। পাশাপাশি এনবিআরের উচিত আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেওয়া। এতে রপ্তানি উৎসাহিত হবে। সেটি না হলে দেশের বাজারে যদি পণ্যের দাম বেশি পাওয়া যায়, তাহলে উদ্যোক্তারা দেশের জন্যই পণ্য বানাবে। রপ্তানি করতে চাইবে না।
ড. এমএ রাজ্জাক বলেন, নির্বাচনের পর অপ্রিয় হলেও আর্থিক খাতে সংস্কারসহ চার খাতে সংস্কারের বিকল্প নেই। অর্থনীতিকে টেকসই করতে হলে এগুলোর প্রয়োজন। তিনি বলেন, মুদ্রা বিনিময় হার যথেষ্ট নমনীয় রাখতে হবে। এক কথায় এই হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। এছাড়া রাজস্ব ঘাটতি বিপদ বাড়াচ্ছে। একদিকে দেশীয় অর্থ কমছে, অপরদিকে রিজার্ভও কমছে। পাশাপাশি বাড়ছে সুদহার। সুদ পরিশোধজনিত ব্যয় ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। সেইসঙ্গে বিদেশি ঋণ পরিশোধও কঠিন হবে।
তিনি আরও বলেন, দেশের অর্থনীতির তুলনায় রপ্তানি খাত বড় নয়। ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়ার তুলনায় আমাদের রপ্তানি অনেক কম। পোশাক খাতে বাইরে নন গার্মেন্টস শিল্পে রপ্তানি বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ দরকার। অর্থাৎ রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রেও সংস্কার আনতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মূল্যস্ফীতি কমানোর কার্যকর উদ্যোগ থাকতে হবে। এক্ষেত্রে আমদানি নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকলে মূল্যস্ফীতি কমবে না। রাজস্ব আদায় বাড়াতে গিয়ে যারা কর দিচ্ছে তাদের চাপ না দিয়ে কর জাল বাড়াতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, জানুয়ারিতে আইএমএফ মিশন বাংলাদেশ ঘুরে গেছে। তারা মোটামুটি সন্তুষ্ট। দ্বিতীয় কিস্তি হিসাবে ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পাওয়া যেতে পারে।