একাদশ সংসদের শেষ অধিবেশন সমাপ্ত, বিল পাশে নতুন রেকর্ড
সংসদ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:০৫ পিএম
একাদশ জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনের সমাপ্তি দিনে বিল পাশে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এদিন সর্বোচ্চ সংখ্যক ৭টি বিল পাশ হয়েছে। যা সংসদের ইতিহাসে রেকর্ড। মাত্র ৯ কার্যদিবসের এই অধিবেশনে ২৫টি বিল পাশ হয়। এর আগে ২৪তম অধিবেশনের ৯ কার্যদিবসে পাশ হয় ১৮টি বিল। সংসদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিরোধী দল জাতীয় পার্টি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি বিল পাশের প্রক্রিয়ায় তারা সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়।
চলতি সংসদের যাত্রা শুরু হয় ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। ২৯ জানুয়ারি এই সংসদের ৫ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হবে। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে, সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। সে অনুযায়ী, পহেলা নভেম্বর থেকে নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে। আর স্বাভাবিক সময়ে একটি অধিবেশন শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে পরবর্তী অধিবেশন বসার বাধ্যবাধকতা থাকলেও নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য সেটা প্রযোজ্য নয়। ফলে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া চলতি সংসদের আর কোনো অধিবেশন বসবে না। আর সেটা হলে বৃহস্পতিবারই চলতি সংসদের অধিবেশন শেষ হয়েছে। ২২ অক্টোবর এ অধিবেশন শুরু হয়।
করোনার প্রভাবে প্রায় দুই বছর স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হলেও চলতি সংসদে অতীতের মতো ওয়াকআউট ও বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের ঘটনা ঘটেনি। নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রয়োজনীয় আইন পাশ হয়েছে। তবে করোনাকালের পর থেকে প্রায় সব প্রশ্নোত্তর টেবিলে উত্থাপন করা হয়। মাঝেমধ্যে শুধু প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। কার্যপ্রণালি বিধির ৭১ বিধির নোটিশ স্থগিত হয়েছে। সংসদে উপেক্ষিত হয়েছে বেসরকারি সদস্যদের সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবে তেমন কোনো সংসদীয় বিতর্ক বা আলোচনা হতে দেখা যায়নি। গত প্রায় ৫ বছরে কোনো মুলতবি প্রস্তাব নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়নি। সংসদীয় কমিটিগুলোও ছিল অনেকটা নিষ্ক্রিয়। এই সংসদের ৩১ জন সংসদ-সদস্যের মৃত্যু হয়েছে।
সংসদের শুরুতে যোগ না দিলেও পরে বিএনপির যোগদানের পর অনেকটা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে সংসদ। টানা সাড়ে ৩ বছর বিএনপির সংসদ-সদস্যরা সংসদে থাকা অবস্থায় সরকারের বিভিন্ন নীতি ও সিদ্ধান্তের সমালোচনায় মুখর ছিলেন। তবে দলীয় সিদ্ধান্তে গত বছরের ১১ ডিসেম্বর সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন বিএনপির সংসদ-সদস্যরা। এরপর বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, গণফোরাম ও স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যরা নানা ইস্যুতে জোরালো বক্তব্য রাখেন।
সংসদ সচিবালয়ের তথ্যানুযায়ী, শেষ অধিবেশনের ৯ কার্যদিবসসহ এই সংসদের মোট কার্যদিবস ছিল ২৭২টি। এর আগে দশম সংসদ ৪১০ কার্যদিবস ও নবম সংসদ ৪১৮ কার্যদিবস চলে। করোনা পরিস্থিতিসহ অন্যান্য সময়ে সংসদ অধিবেশন সংক্ষিপ্ত হওয়ায় চলতি সংসদের কার্যদিবস আগের দুটি সংসদের তুলনায় কম। অনেকটা নিয়মরক্ষার জন্য সংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় নিয়মিত বিরতিতেই চলতি সংসদের অধিবেশন বসেছে। করোনার কারণে মাত্র দেড় ঘণ্টায় একটি অধিবেশন শেষ করা হয়েছে, যা ছিল দেশের ইতিহাসে সংক্ষিপ্ততম সংসদ অধিবেশন। সর্বশেষ দুটি অধিবেশন ছাড়া করোনা পরবর্তী সব অধিবেশনেই সংসদ-সদস্য, সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও গণমাধ্যমকর্মীদের নিয়মিত কোভিড টেস্ট করেই সংসদ অধিবেশনে প্রবেশ করতে হয়েছে। করোনার তীব্র সংক্রামণকালে রোস্টার করে সংসদ-সদস্যদের বৈঠকে অংশ নেওয়ার নিয়ম করা হয়। অধিবেশনের কার্যদিবসগুলো যতদূর সম্ভব কম করা হয়েছে।
চলতি সংসদের প্রথম বছর ২০১৯ সালে ৬১ কার্যদিবস, ২০২০ সালে ৫৩ কার্যদিবস, ২০২১ সালে ৪২ কার্যদিবস, ২০২২ সালে ৪৪ কার্যদিবস এবং চলতি বছরে ৬১ কার্যদিবস অধিবেশন বসেছে। এই সংসদের ২৫টি অধিবেশনের মধ্যে দুটি বিশেষ অধিবেশন ছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর বিশেষ অধিবেশন বসে। পরের বিশেষ অধিবেশনটি ছিল চলতি বছরের এপ্রিলে। জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে এই অধিবেশন বসে।
সংসদ সচিবালয়ের তথ্যানুযায়ী, চলতি সংসদে রেকর্ডসংখ্যক অধিবেশন বসলেও তুলনামূলক কম সংখ্যক বিল পাশ হয়েছে। এই সংসদে ১৬৫টি বিল পাশ হয়েছে। এর আগে নবম সংসদে ২৭১টি ও দশম সংসদে ১৯৩টি বিল পাশ হয়েছিল। এই সংসদে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তরের জন্য ১৩৩৬টি প্রশ্ন পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী ৫৬৬টি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। আর মন্ত্রী উত্তরদানের জন্য পাওয়া ৩০ হাজার ৬৪১টি প্রশ্নের মধ্যে ১৭ হাজার ৭৬২টি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা।
চলতি সংসদে রেকর্ডসংখ্যক ৩১ জন সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। এমন দুঃখজনক ঘটনা অতীতের কোনো সংসদে ঘটেনি। বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বি মিয়া, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ বরেণ্য সংসদ-সদস্যরা মৃত্যুবরণ করেছেন। এরমধ্যে ছয়জন মহামারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। সর্বশেষ ২১ অক্টোবর পটুয়াখালী-১ আসনের সংসদ-সদস্য অ্যাডভোকেট মো. শাহজাহান মিয়া মৃত্যুবরণ করেন। সংসদ-সদস্যদের মৃত্যুজনিত কারণে উপনির্বাচনের বেলায়ও চলতি সংসদে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া কুয়েতের আদালতে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ-সদস্য শহীদ ইসলাম পাপুলের সাজা হওয়ায় বিদেশে নৈতিকস্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে জড়িত থাকায় সংসদ-সদস্য বাতিলের ঘটনাও প্রথম ঘটেছে।
চলতি সংসদে নিয়ম মেনে সরকারি বিল পাশ হলেও কোনো বেসরকারি বিল পাশ হয়নি। এ সংক্রান্ত কমিটি নিয়মিত বৈঠকও করেনি। আর সংসদের কাজ স্থগিত রেখে সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার জন্য মুলতবি প্রস্তাব আনার বিধান থাকলেও জাতীয় সংসদে কোনো মুলতবি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়নি। ২০২২ সালের জুনে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনার দাবি জানিয়েছিলেন বিএনপির সংসদ-সদস্য হারুনুর রশীদ। এ জন্য তিনি ওই বাজেট অধিবেশনে একটি মুলতবি প্রস্তাবও এনেছিলেন। তবে কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, বাজেট অধিবেশনে সাধারণ আলোচনার জন্য মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন করা যায় না। এছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ‘হরিলুট’ ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে সংসদে একদিন আলোচনার ব্যবস্থা করারও দাবি করেছিলেন তিনি। তবে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়নি।
কার্যপ্রণালি বিধিতে জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার বিধান আছে। চলতি সংসদে বেশিরভাগ সময় জনগুরুত্বপূর্ণ নোটিশের ওপর আলোচনা স্থগিত রাখা হয়। এছাড়া কার্যপ্রণালি বিধির ১৪৭ ধারা অনুযায়ী, জনস্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ে আলোচনার জন্য প্রস্তাব (সাধারণ) আনা যায়। এই আলোচনাও খুব বেশি হয়নি। করোনা মহামারি, রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ জাতিকে জানাতে এই বিধিতে একটি প্রস্তাব এনেছিলেন বিরোধী দলের সংসদ-সদস্য মুজিবুল হক। এটি নিয়ে আলোচনা হয়। যা ছিল ব্যতিক্রম। এর বাইরে সংসদে সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্ধারিত কোনো আলোচনা বা বিতর্ক হতে দেখা যায়নি। বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধী দলের সংসদ-সদস্যরা অনির্ধারিত (পয়েন্ট অব অর্ডার) আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে সদুত্তর মেলেনি বলে বিরোধী দলের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, চলতি সংসদে অধিবেশনের কার্যদিবস কম হলেও প্রতিটি অধিবেশন সংবিধান ও কার্যপ্রণালি বিধি মেনে পরিচালিত হয়েছে। সংবিধানের বাধ্যবাধকতার কারণে করোনার ঝুঁকির মধ্যেও অধিবেশন চালাতে হয়েছে। বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের ঘটনা ঘটেনি। ওয়াকআউটের ঘটনাও ছিল খুবই কম। এই সংসদের রেকর্ডসংখ্যক সদস্যের মৃত্যু হলেও বিরোধীদলীয় সদস্যরাসহ সবাই সংসদে বাধাহীন ভাবে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। ফলে সংসদ ছিল পুরোপুরি কার্যকর।
অতীতের যে কোনো সময়ের থেকে চলতি সংসদ অনেক বেশি কার্যকর বলে দাবি করে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা যুগান্তরকে বলেন, সংসদকে কার্যকর করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। অতীতের মতো সংসদ বর্জনের পরিবর্তে বিরোধীদলীয় সংসদ-সদস্যরা সরকারের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিতে সব সময় সোচ্চার ছিল। তারা সংসদীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে।