টিকফা বৈঠক অনুষ্ঠিত
নভেম্বরে সংশোধিত শ্রম আইন চায় যুক্তরাষ্ট্র
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:৪১ পিএম
নভেম্বরের মধ্যে সংশোধিত শ্রম আইন মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন এবং জাতীয় সংসদে উত্থাপন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমান শ্রম আইনটি সংশোধন প্রক্রিয়াধীন। পাশাপাশি শ্রমিক নেতা শহীদুল হত্যাকাণ্ডের তদন্ত দ্রুত শেষ এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বলেছে দেশটি।
বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা) সপ্তম কাউন্সিল বৈঠকে ঢাকায় অনুষ্ঠিত। এতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এসব প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।
বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানি শুল্ক সুবিধা চাওয়া হয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এবং অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশ এ সুবিধা দিচ্ছে বাংলাদেশকে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র দিচ্ছে না। এদিন গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনের (জিএফসি) সহায়তার তালিকায় বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবও দিয়েছে বাংলাদেশ।
রাজধানীর হোটেল কন্টিনেন্টালে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশটির বাণিজ্য বিভাগের প্রতিনিধি (ইএসটিআর) দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার ভারপ্রাপ্ত সহকারী ব্রেডন লিঞ্চ। উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকার রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসসহ ১৩ সদস্যের ইউএসটিআর প্রতিনিধি। তবে বৈঠক শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে স্থান ত্যাগ করেন পিটার ডি হাস।
বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার প্রস্তাবটি জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়। প্রস্তাবের ব্যাপারে যুক্তি দিয়ে বলা হয়, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো এবং অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে বাংলাদেশকে। কারণ বাংলাদেশ হচ্ছে স্বল্প আয়ের দেশ। শুধু যুক্তরাষ্ট্র দিচ্ছে না, এটি দেওয়া উচিত। সভায় বলা হয়, বাংলাদেশের শ্রম অধিকার নিয়ে যুুক্তরাষ্ট্রের যে উদ্বেগ ছিল, সেটি আগের তুলনায় কমেছে। কারণ পরিস্থিতি অনেক উন্নত হয়েছে।
এক্ষেত্রে ইএসটিআর জানায়, জেনাভা কনভেনশনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি অংশ নিচ্ছে এবং উন্নত দেশগুলো কিভাবে এ সুবিধা দিচ্ছে, সে আলোকে বাংলাদেশকে দেওয়ার বিষয়ে চিন্তা করা হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সাংবাদিকদের সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং করেন। এ সময় তিনি বলেন, আমেরিকা থেকে আমাদের মোট চাহিদার প্রায় ১৪ শতাংশ তুলা আমদানি হচ্ছে। এটি ব্যবহার হচ্ছে তৈরি পোশাক খাতে। যুক্তরাষ্ট্রের তুলায় দেশে যে পোশাক তৈরি হয়ে ফের আমেরিকায় রপ্তানি হবে নির্দিষ্টভাবে সেই পোশাকের ওপর শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়। এ প্রস্তাবের বিপরীতে ইএসটিআর প্রতিনিধিদল বলেছে, তাদের দেশের নীতি নির্ধারণী উচ্চপর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবে।
বৈঠকে বাংলাদেশের শ্রম অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ইউএসটিআর প্রতিনিধিদল। বিশেষ করে শ্রমিক নেতা শহীদুল ইসলাম নিহতের ঘটনা তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাওয়া হয়।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ হত্যাকাণ্ডের সংশ্লিষ্টতায় পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সবার ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ করেছেন আদালত। দ্রুত এ হত্যাকাণ্ডের চার্জশিট দেওয়া হবে। এ তথ্য তুলে ধরার পর প্রতিনিধিদলটি সন্তোষ প্রকাশ করেছে। এ ব্যাপারে তারা সুষ্ঠু বিচার চান। পাশাপাশি বর্তমানে বাংলাদেশের শিল্পকারখানায় শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠনে নিবন্ধন পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করায় সভায় সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। প্রতিনিধিদল মনে করছে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ আগের তুলনায় উন্নতি করেছে।
বৈঠকে মেধাস্বত্ব আইন নিয়ে আলোচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যেহেতু বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে যাচ্ছে। ফলে বর্তমান মেধাস্বত্বসংক্রান্ত আইনগুলো আন্তর্জাতিকমানের করতে হবে। বাংলাদেশ বলেছে এ সংক্রান্ত অনেক আইন সংশোধন করা হয়েছে। এরমধ্যে প্যাটেন্ট অ্যাক্ট, কপিরাইট অ্যাক্টও রয়েছে। আইনগুলো বাস্তবায়নের ওপর তারা জোর দেন। তাদের বলা হয়েছে, আইন বাস্তবায়ন একটি চলতি প্রক্রিয়া। আরও সক্রিয় করার চেষ্টা চলছে। বৈঠকে মেধাস্বত্বসংশ্লিষ্ট আইনগুলো আন্তর্জাতিকমানের করতে টেকনিক্যাল সহায়তা চাওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। সহায়তা করতে তারা সম্মতি দিয়েছেন।
এছাড়া টিকফা বৈঠকে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনের (জিএফসি) সহায়তার তালিকায় বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান জিএফসি’র ৭৪০ কোটি মার্কিন ডলারের তহবিল আছে। সেখান থেকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে সহায়তা দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ইএসটিআর প্রতিনিধিদল বলেছে, এই তহবিল পেতে কিছু শর্ত বিশেষ করে জিএসপির মতো শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে। এজন্য সংশোধিত শ্রম আইন নভেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদে পাশ দেখাতে হবে। সংশোধিত শ্রম আইনের মধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) টেকনিক্যাল সুপারিশ সেগুলো বিবেচনা থাকতে হবে। ইএসটিআর বলেছে, এসব ক্ষেত্রে উন্নতি করে দেখাতে পারলে বাংলাদেশকে জিএফসি তহবিল সুবিধায় নাম যুক্ত করার বিষয়টি বিবেচনা করবে।
বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশকে জিএসপি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য সচিব বলেন, নতুন যে জিএসপি রেগুলেশন হতে যাচ্ছে সেখানে কিভাবে বাংলাদেশকে যুক্ত করা যায় সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র চিন্তা করবে এমন আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
টিকফা স্বাক্ষরের ১০ বছর পূর্তি এবার। টিকফা চুক্তি করার পর বাংলাদেশ কি সুবিধা পেয়েছে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব বলেন, টিকফার লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বাড়ানো। এক্ষেত্রে বাধাগুলো দূর করা। বাণিজ্য অবশ্যই বেড়েছে। ৮ বছর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের বাণিজ্য ছিল বাংলাদেশের। এখন সেটি বেড়ে এক হাজার কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। রপ্তানির পরিমাণ দেখলে বাংলাদেশ অনেক বেশি সুবিধা পেয়েছে। তবে অনেক উন্নত দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। সেটি আমেরিকার বাজারে পাওয়া গেলে এই বাণিজ্যের পরিমাণ ১৬শ কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়াত।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানির শুল্ক সুবিধা চাওয়া হয়েছে। এলডিসি উত্তরণের পর আরও কয়েক বছর পর্যন্ত উন্নত দেশগুলো পুরোনো সুবিধা অব্যাহত রাখে সে ব্যাপারে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কাছে প্রস্তাব দিয়েছে এলডিসিগুলো। সে সহায়তায় আমেরিকার সমর্থন চাওয়া হয়। এছাড়া কৃষি পণ্য উৎপাদনসহ অন্যান্য কাজে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের কাছে সহায়তাসহ বাংলাদেশে শিল্প খাতে বিনিয়োগ আহ্বান জানানো হয়।
বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানির ক্ষেত্রে ইএসডিএতে নিবন্ধন করতে অনেক সময় লাগে এবং ব্যয়বহুল। স্বল্পোন্নত দেশ হিসাবে বাংলাদেশে ফি এবং সময় কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
টিকফা স্বাক্ষর হয় ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর। এর আগে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ রূপরেখা চুক্তি (টিফা) নামে ২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশকে চুক্তি স্বাক্ষরের তাগিদ দিতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। টিফাই পরে টিকফা হয়।
চুক্তিতে বলা হয়, বছরে কমপক্ষে একবার এ ফোরামের বৈঠক হবে। সে অনুযায়ী ২০১৪ সালের এপ্রিলে ঢাকায় প্রথম এবং ২০১৫ সালের নভেম্বরে ওয়াশিংটনে দ্বিতীয় বৈঠক হয়। এভাবে ঢাকা-ওয়াশিংটন, ওয়াশিংটন-ঢাকা করে প্রায় প্রতিবছরই টিকফা ফোরামের বৈঠক হয়।