Logo
Logo
×

সুস্থ থাকুন

ফিরে দেখা ২০২৪

চিকিৎসাবিজ্ঞানে যা কিছু অভিনব

Icon

ডা. কাজী সাইফউদ্দীন বেন্নূর

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চিকিৎসাবিজ্ঞানে যা কিছু অভিনব

চিকিৎসাবিজ্ঞান বিস্ময়ের এক মহাসমুদ্র। এ খাতে এত দ্রুত ও নাটকীয়ভাবে নতুন নতুন আবিষ্কার, উদ্ভাবন বা পরিবর্তন হয়ে থাকে, সেসব জানলে হতবাক হয়ে যেতে হয়। ২০২৪ সালের চিকিৎসাক্ষেত্র আমাদের কম বিস্ময় উপহার দেয়নি। এ বছর চিকিৎসাবিজ্ঞানে যা কিছু অভিনব সেটা নিয়ে লিখেছেন ডা. কাজী সাইফউদ্দীন বেন্নূর

চিকিৎসকরা সব সময় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন, দুরারোগ্য ব্যাধিগুলো দ্রুত ও নির্ভুল নির্ণয়ে এবং অনায়াস ও সার্বিক নিরাময়ে নতুন কী কী প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হলো, কোন কোন ওষুধ আবিষ্কৃত হলো। এ বছরটি এক্ষেত্রে আমাদের মোটেই নিরাশ করেনি। আসুন, পরিচিত হওয়া যাক, তেমন কিছু প্রযুক্তি আর প্রক্রিয়ার সঙ্গে; জেনে নেওয়া যাক অভিনব কিছু ওষুধ সম্পর্কে।

* মাইক্রোআরএনএ

চলতি বছর চিকিৎসাশাস্ত্রে যৌথভাবে নোবেল পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস মেডিকেল স্কুলের ভিক্টর অ্যামব্রোস এবং হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গ্যারি রুভকুন। তারা ‘মাইক্রোআরএনএ’ নামক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা আবিষ্কার করেছেন, যা জীবদেহের জিন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। ‘জিন’ যে জীবনের অভিযাত্রায় নিয়ামক হিসাবে কাজ করে তা হয়ত আমরা সবাই মোটামুটি জানি। জিনকে প্রভাবিত করা ‘মাইক্রোআরএনএ’ সম্পর্কে জানতে পারাটা আমাদের কী উপকারে আসবে? সহজ কথায় বলতে গেলে, ক্যানসার, হৃদরোগ, স্নায়ু-বৈকল্য, স্মৃতিভ্রষ্টতা, ইত্যাদি যেসব ব্যাধির কারণ আমরা এখনো ভালোভাবে জানি না এবং কখন তা শুরু হয় তাও আমাদের অগোচরে থেকে যায়, সেসব ক্ষেত্রে ‘মাইক্রোআরএনএ’ এক ধরনের বায়োমার্কার হিসাবে কাজ করবে। ফলে উপসর্গ শুরু হওয়ার আগেই আমরা এ রোগ সম্পর্কে জানতে পারব এবং অগ্রিম সাবধানতা নিতে পারব।

* বর্ধনশীল হার্ট-ভালভ

মায়ের পেট থেকেই হৃৎপিণ্ডের ভালভে ক্রুটি নিয়ে জন্মান শিশুর ভালভ প্রতিস্থাপনে একটা বড় সমস্যা ছিল। কারণ, শিশুর বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে হার্টের আকার বড় হতে থাকে, কিন্তু এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৃত্রিম ভালভ আর বড় হয় না। চলতি বছর এর সমাধানে তৈরি হয়েছে বর্ধনশীল হার্ট-ভালভ, যা মানব শিশুর বিকাশের সঙ্গে আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায়। ঠিক যেমনটা হয় সুস্থ শিশুর জৈবিক ভালভ।

* অ্যালঝেইমার নির্ণয়ে PrecivityAD2 টেস্ট

বয়োবৃদ্ধদের স্মৃতিভ্রষ্টতাজনিত রোগ অ্যালঝেইমার। প্রচলিত পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে রোগটি নির্ণয় করতে সময় লাগে। তবে চলতি বছর PrecivityAD2 টেস্ট নামে একটি পরীক্ষা আবিষ্কৃত হয়েছে, যার মাধ্যমে শুরুতেই রোগটি নির্ণয় কার সম্ভব। এর ফলে আক্রান্ত হওয়ার পরপরই রোগটির চিকিৎসা শুরু করা যাবে।

* খাদ্যে অ্যালার্জি নিয়ন্ত্রণে জৈবভিত্তিক ওষুধ

বায়োলজিক্স বা জৈবভিত্তিক ওষুধকে বলা হয়ে থাকে মেডিসিনের ভবিষ্যৎ। অণুজীব বা জৈবিক সামগ্রী থেকে উৎপন্ন হয় বলে, এ ধরনের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম, ফলাফলও জাদুকরি। ‘ওমালিজুমাব’ নামের একটি বায়োলজিক ওষুধ এতদিন অ্যাজমা এবং অ্যালার্জিজনিত নাকের প্রদাহ ও চর্মরোগে ব্যবহৃত হতো। চলতি বছর এক গবেষণায় দেখা গেছে, এটি সফলভাবে খাদ্য থেকে উদ্ভূত অনেক অ্যালার্জি মোকাবিলা করতে পারে। চিনাবাদাম, চিংড়িমাছ কিংবা অন্যান্য অ্যালার্জিক খাবার দেখলে যারা আঁতকে উঠতেন, তারা নিশ্চয়ই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারেন।

* ভিন্ন জীবের অঙ্গ মানবদেহে প্রতিস্থাপন

কিডনি, হার্ট, লিভার ইত্যাদি অঙ্গ প্রতিস্থাপনে সবচেয়ে বড় বাধা সম্ভবত সঠিক ডোনার খুঁজে পাওয়া। চলতি বছর বিজ্ঞানীরা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে জিন পুনর্বিন্যাস করে পরীক্ষামূলকভাবে শূকরের কিডনি মানবদেহে প্রতিস্থাপনে সক্ষম হয়েছেন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের কাছে অস্বস্তিকর বা অগ্রহণযোগ্য মনে হলেও, অদূর ভবিষ্যতে এটি হয়তো গ্রহণযোগ্য কোনো জন্তু দিয়ে বিকল্প হিসাবে আমাদের নাগালে চলে আসবে।

* পুরুষের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণের ওষুধ

অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ রোধের দায়িত্ব কেবল নারীদের ওপর আর থাকলো না। নারীদেহে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার ভয়ও কেটে যাবে। এ বছর পুরুষদের জন্যও আবিষ্কৃত হয়েছে বার্থ কন্ট্রোল পিল। কনডম বা অন্য ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে যেসব পুরুষ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না, এটি হয়তো তাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। তবে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে যেন অসামাজিকতা যাতে বেড়ে না যায় সেদিকটাও খেয়াল রাখা জরুরি।

* অভিজ্ঞ সার্জনের দৃষ্টিরেখা বিশ্লেষণ

এ বছর আই-ট্র্যাকিং পদ্ধতি ব্যবহার করে অস্ত্রোপচারের সময় একজন অভিজ্ঞ এবং নিখুঁত সার্জন অপারেশনের সময় কী কী দেখেন, কখন কোন সিদ্ধান্ত নেন তা সুচারুভাবে রেকর্ড করার মেশিন আবিষ্কার হয়েছে। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে সমন্বিতভাবে এক ধরনের ভার্চুয়াল অপারেশন থিয়েটার নির্মাণের কাজ চলছে। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে নবীন সার্জনরা দ্রুত দক্ষ এবং নির্ভুল হয়ে উঠবেন। রেডিওলজিস্ট এবং প্যাথলজিস্টদের প্রশিক্ষণেও এ পদ্ধতি অচিরেই কার্যকরী হয়ে উঠবে।

* স্বাস্থ্য নিরীক্ষণে সেন্সরযুক্ত পোশাক

এ বছর ন্যানোম্যাটেরিয়ালযুক্ত এক ধরনের জামা তৈরির কাজ অনেকদূর এগিয়েছে। এ পোশাক পরিয়ে কোনো ব্যক্তির সারা দিনের অঙ্গ-সঞ্চালন, শ্বাস গ্রহণ, হৃদযন্ত্রের কার্যকলাপ, রক্ত চলাচল, লিভার-কিডনির কার্যক্রম, এক কথায় স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সর্ববিধ তথ্যাবলী প্রতিমুহূর্তেই পর্যবেক্ষণ, সংরক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করা যাবে। ফলে তার রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা নির্ধারণ করা সহজসাধ্য হয়ে উঠবে। পরীক্ষা চলাকালীন ওই ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবেই দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পাদন করবেন। মজার ব্যাপার, পোশাক তৈরিতে সামুদ্রিক শৈবালের প্রলেপ ব্যবহার করা হয়েছে।

* এআই এবং মেশিন লার্নিংয়ের প্রয়োগ

এ বছর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এ আই) ও মেশিন লার্নিং বা যান্ত্রিক শিক্ষণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কিছু কিছু শারীরিক রোগ এবং বহু মানসিক ব্যাধির বিষয়ে রোগীদের চাল-চলন, প্রতিক্রিয়া এবং শারীরিক মার্কারগুলো বিশ্লেষণ করে এক ধরনের অ্যালগরিদম বা গাণিতিক প্রকলন করা হয়। এই অ্যালগরিদম ব্যবহার করে সহজেই রোগীর অবস্থা সম্বন্ধে আগাম ধারণা করা যায় এবং সে অনুসারে আগেভাগেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়।

* সম্ভাব্য যুগান্তকারী ওষুধ

এ বছর বেশকিছু আশাব্যঞ্জক নতুন ওষুধের সন্ধান পাওয়া গেছে। মনে করা হচ্ছে এদের সবাই অথবা কেউ কেউ স্ব স্ব ক্ষেত্রে হয়ে উঠতে পারে সফলতম মেডিসিন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, এইডসের চিকিৎসায় লেনাক্যাপাভির (Lenacapavir), সিজোফ্রেনিয়ার জন্য জেনোমেলিন ট্রসপিয়াম (Xanomeline-trospium), স্থূলতারোধে টিরজেপাটাইড (Tirzepatide) এবং ফুসফুসের ক্যানসার নিরাময়ে অসিমেরটিনিব (Osimertinib)-এর কথা। এ ওষুধগুলো বিশাল সম্ভাবনার দ্বার আমাদের সামনে খুলে দিয়েছে। ভবিষ্যৎই কেবল বলতে পারে, এদের মধ্যে কোনটি একদিন ‘গেম-চেঞ্জার’ হিসাবে আবির্ভূত হবে।

লেখক : সিনিয়র কনসালটেন্ট, ইউনাইটেড হসপিটাল, ঢাকা, জয়েন্ট সেক্রেটারি, বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম