এই সময়ে মানসিক সুস্থতায় করণীয়
ডা. সাইফুন নাহার
প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বর্তমান সামাজিক পরিস্হিতি এবং ধারাবাহিক প্রক্রিয়া নারী, পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ, বয়স, পেশা, সমাজিক অবস্হান নির্বিশেষে সারাদেশের মানুষের মনে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, আতন্ক তৈরী করে চলেছে। মানুষ ঘুমাতে পারছেনা, খেতে পারছেনা, কাজে মনোযোগ দিতে পারছেনা। ঘরে এবং বাইরে, কর্মস্হলে কোথাও জীবনের নিরাপত্তা নেই।সকল পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। জনজীবনে নেমে এসেছে অর্থনৈতিক ধ্বস।চোখের সামনে মানুষ দেখেছে তাজা প্রাণগুলো ঝরে যেতে। দেখেছে মানুষের জিঘাংসা। যারা রাজনীতি করেন এবং যারা করেন না, সকল মানুষের মনে রাষ্ট্রের অদূর ভবিষ্যত নিয়ে প্রতি মূহুর্তে চলছে নানা ধরনের অজানা আশংকা। স্বাধীনতার আনন্দে মানুষ উদ্বেলিত হয়েছে কিন্ত এখনও জনজীবনে নেমে আসেনি স্বস্তি। উদ্বেগ, হতাশা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।সাথে রয়েছে স্বজন হারানোর শোক।যখন সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্হিরতা নাগরিক অস্থিরতায় পরিণত হয়, তখন এর প্রভাব ধ্বংসাত্মক হতে পারে। এটি মানুষের শরীর এবং মন উভয়ের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, এমনকি যদি কেউ সংঘর্ষের আশেপাশের ঘটনাগুলির সাথে সরাসরি জড়িত নাও হন।
* মানসিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব
রাজনৈতিক বা সামাজিক অস্থিরতার মতো উচ্চ-চাপের ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করার পরে মানুষের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এর মধ্যে রয়েছে অনুরূপ ঘটনাগুলোর সঙ্গে ব্যক্তির পূর্বের অভিজ্ঞতা, ঘটনা বা দুর্ঘটনার আগে শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক সমর্থন এবং ব্যক্তিবিশেষে চাপ মোকাবিলার কৌশল ইত্যাদির উপর। এসব ক্ষেত্রে যেসব লক্ষণ সাধারণত দেখা যায় সেগুলো হলো-
▶ শক : এমন অনুভূতি যে ঘটনাটি ‘অবাস্তব’।
▶ ভয় এবং উদ্বেগ : নিজের, সহকর্মীদের এবং প্রিয়জনদের নিরাপত্তা নিয়ে এ ভয় ও উদ্বেগ কাজ করে।
▶ দুঃস্বপ্ন : সম্ভাব্য দৃশ্য বা ফ্ল্যাশব্যাক যা ঘটানার সময় প্রত্যক্ষ হয়েছে।
▶ খেতে বা ঘুমাতে সমস্যা।
▶ ভুলে যাওয়া।
▶ রাগান্বিত হওয়া।
▶ অতি-সক্রিয়তা বা অলসতা।
▶ নেতিবাচকতা।
▶ মানসিক অবসাদ।
▶ পর্যাপ্ত ঘুমানোর পরও চরম ক্লান্তি।
▶ শারীরিক প্রতিক্রিয়া-যেমন পেটে ব্যথা, মাথাব্যথা, ঝাঁকুনি বা পেশিতে টান ইত্যাদি।
▶ বিভিন্ন প্রকার মানসিক রোগ দেখা দেওয়া বা পূর্বের মানসিক রোগ প্রকট হওয়া।
* উত্তরণের উপায়
▶ প্রথমত এসবের মানসিক প্রভাব সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে অর্থাৎ জানতে হবে। মানসিক চাপের কিছু সাধারণ প্রতিক্রিয়া রয়েছে যা মানুষ অস্থির সময়ে অনুভব করতে পারেন।
▶ যেহেতু আমাদের মস্তিষ্ক উচ্চ-চাপের ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছে, তাই আমরা যদি আমাদের অনুভূতি অস্বীকার করার চেষ্টা করি বা প্রতিক্রিয়াগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার চেষ্টা করি তবে এ সমস্যা থেকে পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়াটিকে ধীর করে দিতে পারে। তাই, আমরা আমাদের এ অনুভূতিগুলোকে যদি মন থেকে গ্রহণ করতে পারি তাহলে এটি আমাদের মানসিক অসুস্থতা নিরাময়ে সহায়ক হবে।
▶ যদি মানসিক বা শারীরিক প্রতিক্রিয়াগুলো অনেক সপ্তাহ ধরে দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপ এবং আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক, সামাজিক এবং পেশাগত জীবনকে বাধাগ্রস্ত করে, তাহলে আমরা মানসিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারি।
* আঘাত পরবর্তী মানসিক চাপে করণীয়
মানসিক চাপ বা আঘাত পরবর্তী বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগ প্রতিরোধ করতে আমরা কিছু কৌশল অবলম্বন করতে পারি। যেমন-
▶ যখন ফ্ল্যাশব্যাক বা স্বপ্ন দেখা দেয়, যা সাধারণত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পায়, এটি যদি আমাদের জানা থাকে তাহলে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় তা সহায়ক হতে পারে।
▶ যদি আমরা আমাদের প্রতিক্রিয়াগুলো গ্রহণ করতে সক্ষম হই এবং তাদের সঙ্গে লড়াই না করি তবে এ উপসর্গগুলো সাধারণত দ্রুত চলে যায়।
▶ আমাদের জানতে হবে, বেশিরভাগ লোক যারা একটি আঘাতমূলক ঘটনা অনুভব করেন, তাদের বেশিরভাগের পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হয় না। তাই চাপ মোকাবিলা করার জন্য অ্যালকোহল বা ড্রাগ ব্যবহার করা এড়িয়ে চলুন।
▶ পর্যাপ্ত ঘুমের জন্য নিয়ম কানুন মেনে চলুন।
▶ নিয়মিত মেডিটেশন, রিলাক্সেশন চর্চা, শারীরিক ব্যায়াম, খেলাধুলা ও অন্যান্য বিনোদনমূলক কাজে অংশগ্রহণ করুন।
▶ দুর্ঘটনাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ান। ভয়কে জয় করুন।
▶ আত্মহত্যা, হত্যার মতো চিন্তা মাথায় এলে তাৎক্ষণিক মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। প্রয়োজনে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিন।
লেখক : মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সহযোগী অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান, এডিকশন সাইকিয়াট্রি ডিপার্টমেন্ট, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা।