সিপিআর : জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা পদ্ধতি
অধ্যাপক ডা. মো. তৌফিকুর রহমান ফারুক
প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সিপিআর বা কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন, একটি জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা পদ্ধতি, যা জরুরি অবস্থায় হৃৎপিণ্ড এবং শ্বাস-প্রশ্বাস পুনরুদ্ধার করতে ব্যবহৃত হয়। এটি সাধারণত কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট (হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়া) বা শ্বাসরোধজনিত পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করা হয়। সিপিআর দুটি প্রধান উপাদানের সংমিশ্রণে সম্পন্ন হয়। বুকের সংকোচন (চেস্ট কমপ্রেশন) এবং কৃত্রিম শ্বাস (রেস্কিউ ব্রিদিং)।
* সিপিআরের মৌলিক উদ্দেশ্য
▶ অক্সিজেন সরবরাহ : সিপিআরের মূল লক্ষ্য হলো মস্তিষ্ক এবং হৃৎপিণ্ডে অক্সিজেনযুক্ত রক্তের প্রবাহ বজায় রাখা, যাতে টিস্যুগুলোতে অক্সিজেনের অভাব না হয়।
▶ মস্তিষ্কের ক্ষতি প্রতিরোধ : মস্তিষ্কের কোষগুলো অক্সিজেনের অভাবে দ্রুত ক্ষতি হতে পারে। সিপিআর দ্রুত প্রয়োগ করলে এটি রোধ করতে পারে এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে।
▶ রক্ত সঞ্চালন পুনরুদ্ধার : বুকের সংকোচন দ্বারা রক্ত সঞ্চালন চালু রাখা হয়, যা প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলোতে রক্ত প্রবাহ নিশ্চিত করে।
* প্রয়োজনীয়তা
সিপিআর তখনই করতে হবে যখন-
▶ হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যায় : যখন ব্যক্তির হৃৎপিণ্ড কাজ করা বন্ধ করে দেয় এবং পালস পাওয়া যায় না।
▶ শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় : যদি ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে না পারে বা শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিক হয় (যেমন-অ্যাগনাল রেসপিরেশন)।
* সিপিআরের ধাপ
▶ পরিস্থিতি মূল্যায়ন : প্রথমে নিশ্চিত করুন যে, পরিবেশ নিরাপদ। কোনো বিপদ আছে কি না সেটাও দেখুন। আক্রান্ত ব্যক্তিকে ডাকুন। ‘আপনি কি ঠিক/ ভালো আছেন?’- এসব জিজ্ঞেস করুন এবং সাড়া দেয় কিনা দেখুন। শ্বাস নিচ্ছে কিনা তা দেখুন এবং পালস অনুভব করার চেষ্টা করুন। যদি পালস না থাকে এবং শ্বাস না নেয়, তাহলে সিপিআর শুরু করতে হবে।
▶ জরুরি সেবা যোগাযোগ : যদি আক্রান্ত ব্যক্তির পালস না পাওয়া যায় এবং শ্বাস না নেয়, তবে অবিলম্বে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে সাহায্য চাইতে হবে। জরুরি সেবা না আসা পর্যন্ত সিপিআর চালিয়ে যেতে হবে।
▶ বুকের চাপ (চেস্ট কমপ্রেশন) : দুই হাতের তালু এক করে বুকের মাঝের অংশে রাখুন। প্রতি মিনিটে ১০০ থেকে ১২০ বার চাপ দিন, চাপ দেওয়ার গভীরতা প্রায় ৫ থেকে ৬ সেমি (২ ইঞ্চি) হওয়া উচিত। চাপ দেওয়ার পর বুককে সম্পূর্ণ শিথিল করুন যাতে হৃৎপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালন সঠিকভাবে হতে পারে।
▶ কৃত্রিম শ্বাস (রেস্কিউ ব্রিদিং) : প্রতি ৩০টি চাপ বুকে দেওয়ার পর ২টি কৃত্রিম শ্বাস দিন। আক্রান্ত ব্যক্তির নাক বন্ধ করুন এবং মুখের মাধ্যমে শ্বাস দিন। নিশ্চিত করুন যে বুক উঠছে। শিশুদের ক্ষেত্রে, ১৫:২ অনুপাত ব্যবহার করা হয়। শিশুদের বুকের চাপ দেওয়ার সময় দুই আঙুল ব্যবহার করুন এবং মুখ এবং নাক ঢেকে দিন।
▶ AED (অটোমেটেড এক্সটারনাল ডিফিব্রিলেটর) ব্যবহার করুন : যদি AED উপলব্ধ হয়, দ্রুত তা ব্যবহার করুন। এটি হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। AED ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী অনুসরণ করুন।
* কার্যকারিতা
▶ মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব : সাধারণত, ৪ মিনিটের মধ্যে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে মস্তিষ্কে ক্ষতি হতে শুরু করে, এবং ৭ মিনিট পর এটি স্থায়ী হতে পারে।
▶ রক্তের প্রবাহ : সিপিআর শুরু করার পর যত দ্রুত সম্ভব রক্তপ্রবাহ চালু করতে হবে।
* সময়কাল
যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত সঞ্চালন ফিরে না আসে বা চিকিৎসক এসে মৃত ঘোষণা না করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত সিপিআর চালিয়ে যেতে হবে।
* চ্যালেঞ্জ এবং সমস্যা
▶ গতি ও গভীরতা : বুকের চাপ দেওয়ার গতি ও গভীরতা সঠিকভাবে বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি চাপ দেওয়ার গতি কম বা বেশি হয়, তাহলে রক্তের সঞ্চালন কমে যেতে পারে এবং এটি গুরুতর ক্ষতির কারণ হতে পারে।
▶ অপ্রশিক্ষিত উদ্ধারকারীদের জন্য : অপ্রশিক্ষিত উদ্ধারকারীদের জন্য বুকের চাপ দিয়েই সিপিআর করা যেতে পারে, কৃত্রিম শ্বাস দেওয়া বাদ দেওয়া যেতে পারে।
* বিশেষ পরিস্থিতি
▶ শিশুদের সিপিআর : শিশুদের ক্ষেত্রে বুকের চাপ এবং শ্বাস দেওয়ার অনুপাত আলাদা হতে পারে। শিশুদের শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা সাধারণত কার্ডিয়াক সমস্যার চেয়ে বেশি দেখা যায়, তাই কৃত্রিম শ্বাস দেওয়ার গুরুত্ব বেশি।
▶ নবজাতকের সিপিআর : নবজাতকের ক্ষেত্রে বুকের চাপ এবং শ্বাস দেওয়ার অনুপাত ৩০:২, যদি একজন উদ্ধারকারী থাকে এবং ১৫:২, যদি দুজন উদ্ধারকারী থাকে।
* পরবর্তী পদক্ষেপ
কখনো কখনো হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনরুদ্ধার করতে বৈদ্যুতিক শক (ডিফিব্রিলেশন) প্রয়োজন হতে পারে। সিপিআর করার সময় ডিফিব্রিলেটর ব্যবহার করা হলে এটি রক্ত সঞ্চালন চালু রাখার পাশাপাশি হৃৎপিণ্ডের ছন্দ ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে।
* উপসংহার
সিপিআর হলো একটি জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা প্রক্রিয়া। এটি যেকোনো অবস্থাতেই গুরুত্বপূর্ণ। এটি শেখা ও প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রত্যেকের জন্য আবশ্যক। সঠিক সময়ে এবং সঠিকভাবে সিপিআর প্রয়োগ করলে, এটি মানুষের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করতে পারে। সিপিআরের মাধ্যমে চিকিৎসার সময়সূচি বাড়ানো এবং মস্তিষ্কের ক্ষতি প্রতিরোধ করা সম্ভব। সিপিআর শেখার মাধ্যমে আমরা নিজের এবং অন্যের জীবন বাঁচাতে সহায়তা করতে পারি।
* শিক্ষণীয় বিষয়
▶ সিপিআর এবং AED ব্যবহারের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করুন।
▶ পরিস্থিতি নিরাপদ কিনা তা নিশ্চিত করুন।
▶ দ্রুততার সঙ্গে সিপিআর শুরু করুন, কারণ এটি জীবন বাঁচানোর মূল চাবিকাঠি।
▶ বুকের চাপ দেওয়ার গভীরতা ও গতি বজায় রাখুন।
▶ একাধিক উদ্ধারকারী থাকলে কাজের মধ্যে সমন্বয় করুন এবং ডিফিব্রিলেটরের প্রস্তুতি নিন।
লেখক : মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেস, মালিবাগ, ঢাকা।